ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে অনেকটা একই কাতারে এসেছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে। আর জামায়াত কোনো মাস উল্লেখ না করে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন করার ওপর জোর দিয়েছে। সেক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন প্রস্তাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মৌলিক সংস্কার না হলে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে এনসিপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন হলে ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই। এ মুহূর্তে এনসিপি সংস্কার এবং বিগত সরকারের সময় গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ও গণপরিষদ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘এনসিপির মূল দাবি হচ্ছে রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মৌলিক সংস্কার এবং একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে হত্যা, গণহত্যায় অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করা। মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সরকারের ঐকমত্যে পৌঁছানো। এসব বিষয়কে এনসিপি ফোকাস করেছে। এ দাবিগুলো যত দ্রুত সময়ে পূরণ হবে তত দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের সময় নিয়ে আমাদের এত বেশি কনসার্ন নেই। দাবিগুলো যদি পূরণ হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ডিসেম্বর বা জানুয়ারি নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই।’
নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধু জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গণপরিষদ নির্বাচনে জোর দিয়েছে এনসিপি। দলটির নেতারা বলছেন, বারবার ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসা চিরতরে বন্ধ করা, সংবিধান পুনর্লিখন ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন গণপরিষদ। সেই গণপরিষদ নতুন সংবিধান তৈরি করবে এবং সেই সংবিধানের অধীনে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে সব পক্ষ চাইলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গেও হতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, ‘যেহেতু আমরা নতুন সংবিধানের কথা বলছি, সেহেতু আমরা গণপরিষদ নির্বাচন আগে চাই। সেটা গণপরিষদ কাম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও হতে পারে। এ ব্যাপারে ঐকমত্য এবং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার যত দ্রুত হবে, নির্বাচন তত দ্রুতই হতে পারে। আমাদের ফোকাস জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে ধারণ করে সংবিধান ও রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার করা। সেটা দৃশ্যমান করার জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছি।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন হলে আমরা কখনোই আপত্তি করিনি, করবও না। সেটি যদি ডিসেম্বরে হয়, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই। মৌলিক সংস্কারের মানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। এ জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা কখনোই আপত্তি করিনি বা দ্বিমত জানাইনি।’
এর আগে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখানে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গুণগত পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে গেলে সেটি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।’
এ ছাড়া প্রশাসন নিরপেক্ষ নয় বলে মন্তব্য করেও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি প্রশাসন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে। অনেক জায়গায় এবং মাঠপর্যায়ে যে ধরনের চাঁদাবাজি চলছে, সেই জায়গায়ও মাঠ প্রশাসন আসলে নিশ্চুপ বা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আমরা বলেছি, যদি এ ধরনের একটা প্রশাসন থাকে, তাহলে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ আমাদের ঠিক করতে হবে।’
নাহিদ ইসলাম এমন মন্তব্য করলেও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই এনসিপির নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে দলটি। বিভিন্ন আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এনসিপি কাজ করছে বলে জানিয়েছেন দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে মাত্র এক মাসের দল এনসিপি। তাই সারা দেশে প্রার্থী মনোনয়নে অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের লক্ষ্য ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়া। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।’
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি গণপরিষদ নির্বাচন হওয়া উচিত, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রথমে জাতিকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপস্থাপন করবেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।’