বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব জায়গায় বসার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রাণকেন্দ্র পৌর শহরে দৃষ্টি নন্দন ৩ তলা বিশিষ্ট একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করে। অথচ যাদের জন্য এই ভবনটি নির্মাণ করা হয় সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন কাজে আসছে না সরকারের এই প্রকল্প থেকে। বিগত দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বিয়ানীবাজার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স ভবনটি। আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের অঘোষিত কার্যালয় হিসেবে এই ভবনটি ব্যবহার করার কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাগনের যাতায়াত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতন হওয়ার পর সম্প্রতি এই ভবন দখল করে এনা পরিবহনের বাস কাউন্টার করা হয়েছে। শুধু তাই নয় কমপ্লেক্স ভবনের প্রধান ফটকের সামনে সাইনবোর্ড লাগানোর পাশাপাশি এনা পরিবহনের নিজস্ব গাড়ি ভবনের সামনে রাখা হয়। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন কিংবা এর সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরে আসলেও যেন তাদের করার কিছুই নেই। আর মুলত এসব কারণে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিজস্ব ঠিকানায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
সরেজমিনে বিয়ানীবাজার পৌর শহরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স এর সামনে রাখা হয়েছে এনা পরিবহনের বাস। কমপ্লেক্স ভবননের প্রধান ফটকে লাগানো রয়েছে এনা পরিবহনের নিজস্ব কাউন্টার এর সাইনবোর্ড। দূর থেকে দেখলে মনে হনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স যেন একটা মিনি বাস টার্মিনাল।
জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ অর্জনের স্মারক সংসদ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। অথচ ব্যবসায়িকভাবে একটি মহল মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনকে অস্থায়ীভাবে দখল করে রেখেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমাণ্ডের দায়িত্বশীলরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করেছেন অনেকেই। একই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে এনা বাসের সাইন বোর্ড সরানোর দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের উপজেলা শাখার সাবেক আহবায়ক শাহাজাহান সিদ্দিক।
মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সদস্য সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সের সামনে এনা বাসের বিশাল সাইন দেখে খারাপ লাগে। এটা কোনভাবে মেনে নেয়ার বিষয়ি নয়। আমি প্রশাসনের দায়িত্বশীলকে আহবান করবো যেন দ্রুত সাইন বোর্ডটি অপসারণ করা হয়। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমাণ্ডের সাবেক আহবায়ক সুহেল আহমদ রাশেদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের একটি অধ্যায়। আর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে সে গৌরব বহন করছে। অথচ এটাকে একটি বাসের কাউন্টার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যারা এ ভবনটি প্রথম দেখবেন তাদের কাছে একটি বাসের কাউন্টার মনে হবে। আমি এ ঘটনার নিন্দা জানাই। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমাণ্ডের সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন লোদী বলেন, যারা এনা বাসের সাইন বোর্ড টানিয়েছেন তারা কি প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার অনুমতি নিয়েছেন। যদি না নিয়ে থাকেন তাহলে কিভাবে সাইন বোর্ড টানালেন। এতোদিন পরও দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ কেন নেননি। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।
তাছাড়া নির্বাচন না হওয়ায় বিগত সাড়ে ৭ বছর থেকে অকার্যকর হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের ক্যাম্পাস মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স ভবন। নির্বাচিত কমিটি না থাকায় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেই কোনো কার্যক্রম। প্রশাসনিকসহ যতটুকু কার্যক্রম রয়েছে তাও চলছে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে। বিয়ানীবাজারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসে প্রয়োজন ছাড়া না যাওয়ায় অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ থাকে কার্যালয়। ফলে এক সময়ের জমজমাট এই সংগঠনটি ক্রমেই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে। নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাগণ না আসায় এবং কোনো কার্যক্রম না থাকায় অনেকটা ভূতুড়ে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে সংগঠনটি। ভবনের অধিকাংশ রুমের দরজা-জানালা ভাঙা।
সরজমিন প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করেও দেখা মিলেনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। কোনোদিন হাতেগোনা দুই-এক মুক্তিযোদ্ধা এলেও তাদের পরামর্শ দেওয়ারও কেউ নেই।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৩ মে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে সেই নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এরপর নির্বাচন নিয়ে আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও এই নির্বাচন নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি সূত্র বলছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাচাই করার উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করে জামুকা অধ্যাদেশ তৈরি করা হচ্ছে। অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হওয়ার পরেই বড় পরিসরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করা হবে দেশজুড়ে। এই কাজে মাঠপর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করা হবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মুস্তফা মুন্না বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে সক্রিয় করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই ভবনটি সম্পুর্ন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আর কেউ যদি কমপ্লেক্স এর সামনে গাড়ি রাখেন কিংবা সাইনবোর্ড লাগান তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটা কোনভাবে ঠিক হয়নি। যারা সাইন বোর্ড টানিয়েছেন তাদেরকে বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।