• সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১০:৪০ অপরাহ্ন

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিলেটের চা বাগানের শিশুরা

ডেস্ক রিপোর্ট / ১ Time View
Update : সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫

দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত সিলেটের চা শিল্প। এই শিল্পের ভিত গড়ে তুলেছেন যাঁরা, সেই সব চা শ্রমিকরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাঁদের সন্তানদের ভাগ্যে এখনো জোটেনি শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ। সিলেটের বেশিরভাগ চা বাগানেই সরকারি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বুরজান, কালাগুল, ছড়াগাং ও খাদিম এলাকার চা বাগানগুলোতে শত শত শিশু বেড়ে উঠছে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে। অথচ প্রতিটি বাগানেই শিশুদের সংখ্যা শতাধিক। জেলার আটটি উপজেলায় ছড়িয়ে থাকা ১৩০টিরও বেশি চা বাগানের অধিকাংশেই নেই সরকারি কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কিছু জায়গায় বাগান কর্তৃপক্ষ কিংবা চা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ছোট আকারের প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, তবে সেগুলোর অবকাঠামো দুর্বল, শিক্ষকসংখ্যা কম এবং সরকারের সরাসরি তদারকি নেই। তথ্য মতে উপজেলাভিত্তিক চিত্র, সিলেট সদরের মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা বাগানে এক-দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও অধিকাংশ বাগানে স্কুল নেই। জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটে চা বাগান রয়েছে প্রায় ৩০টির মতো, কিন্তু সেখানে সরকারিভাবে পরিচালিত বিদ্যালয় প্রায় শূন্য। ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জে কিছু চা বাগানে এনজিও কিংবা চা বোর্ডের সহায়তায় ছোটখাটো প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু আছে, তবে অধিকাংশই বেসরকারিভাবে পরিচালিত। কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজারে এসব উপজেলায়ও একই চিত্র নেই সরকারি বিদ্যালয়, শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা দূরের স্কুলে নির্ভরশীল। এ বিষয়ে আকাখাজা চা বাগানের শ্রমিক সাবিত্রী তন্তি বলেন, আমার মেয়ে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে যায়। কাঁদা মাখা পিচ্ছিল রাস্তায় বৃষ্টির দিনে বের হওয়াই যায় না। তখন দিন চলে যায় ঘরেই বসে। এত কষ্টে আর মন টেকে না পড়াশোনায়। শেষ পর্যন্ত ক্লাস ফাইভেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয় তাকে। স্বপ্নটা ওখানেই থেমে যায়।” চা শ্রমিক নেতা সুরমা তান্তি আক্ষেপ করে বলেন, সারাদিন রোদে-পিচ্ছিল মাটিতে কাজ করে ফিরি ক্লান্ত দেহে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগে, যখন দেখি আমাদের শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। তাদের ভবিষ্যৎ যেন শুরুতেই থমকে যায়। কাছে কোনো সরকারি স্কুল নেই । যারা যায়, তারা ২–৩ কিলোমিটার হেঁটে দুরের সরকারি স্কুলে যায়, ঝড়-বৃষ্টি হলে তা আর সম্ভব হয় না। এই কষ্টে শিক্ষা টেকে না, স্বপ্নও ঝরে পড়ে। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ মদন মোহন কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন – সিলেট অঞ্চলে প্রায় শতাধিক চা-বাগান রয়েছে। এসব বাগানে বসবাসরত হাজার হাজার শ্রমজীবী পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কঠোর পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব বাগানে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা তো চিন্তাই করা যায় না। ফলে মেয়েশিশুদের শিক্ষার সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। হাজারো পরিবারের মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে অশিক্ষিত অবস্থায় বড় হচ্ছে। নারীশিক্ষা একটি জাতির উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলেও এই জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা সত্যিই লজ্জাজনক। এখন সময় এসেছে চা-বাগানগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের। এতে এই শিশুদের জীবনে আলো আসবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি সম্ভাবনাময়, আলোকিত আগামী। সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আমার জানা মতে সিলেটের চা বাগান এলাকায় কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, তবে সেগুলো কিছুটা দূরে অবস্থিত। জেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নিয়মিতভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এ বরাদ্দ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাতে যেমন, শিক্ষা উপকরণ ক্রয়, বিদ্যালয় সজ্জাকরণ ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সরকারি নিম্ন-মাধ্যমিক একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন, চা-বাগান এলাকায় যদি অন্তত একটি সরকারি স্কুল থাকত, তাহলে অভিভাবকদের মধ্যে অনেক বেশি দায়িত্ববোধ তৈরি হতো। তারা শিক্ষার গুরুত্বটা বুঝতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখানে অনেকেই এখনো জানেন না, স্কুলে যাওয়া কেন দরকার, লেখাপড়া কেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এতটা জরুরি। আমরা শিক্ষক হিসেবে যতটা পারি, ততটা বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু যখন চারপাশে নেই কোনো কাঠামোগত শিক্ষা-ব্যবস্থা, তখন সচেতনতা তৈরিটাও একরকম অসম্ভব হয়ে ওঠে। শিক্ষা যে জীবন বদলাতে পারে এই বিশ্বাসটা জন্মাতে হলে আগে শিক্ষার সুযোগটা নিশ্চিত করা দরকার।” এ বিষয় একটি এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক সালেহা খাতুন বলেন, চা বাগান এলাকায় যদি একটি সরকারি স্কুল থাকত, তাহলে অভিভাবকরা আরও দায়িত্বশীল হতেন, শিক্ষার গুরুত্বটা বুঝতেন। কিন্তু এখানে অনেকেই এখনো জানেন না স্কুলে যাওয়া কেন প্রয়োজন, লেখাপড়া কেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এত জরুরি। আমরা শিক্ষক হিসেবে যতটা পারি বোঝাই, কিন্তু কাঠামোগত শিক্ষা-সুবিধা না থাকলে সচেতনতা তৈরিও কঠিন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে “কাউকে পেছনে ফেলে নয়” (Leave No One Behind), এই নীতির অর্থ হচ্ছে উন্নয়নের ধারা এমন হতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ ও জনগোষ্ঠী উপকৃত হয় এমন নীতি গ্রহণ করা। বিশেষ করে যারা সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে তাদের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। সুতরাং চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী যদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে তাহলে এই লক্ষ্যমাত্রা কিভাবে অর্জিত হবে? চা শ্রমিক সন্তানরাই যদি লেখাপড়া না করতে পারে তাহলে কি ভাবে এই সমাজ, দেশ সামনে এগোবে। তাই আমি মনে করি সরকারে উচিৎ দেশের সকল চা বাগানগুলোতে জরুরীভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্হাপন করা এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন, চা জনগোষ্ঠী আজও মূল স্রোতধারার শিক্ষা ও উন্নয়ন থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এর প্রধান কারণ হলো শিক্ষার অভাব। যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা প্রসারে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল, সেখানে বরং চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই আমাদের সংগঠন ‘প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘ’ দীর্ঘদিন ধরে চা বাগানের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় শিক্ষার ধারায় ফিরিয়ে আনা এবং তাদের মানোন্নয়নে আমরা বিনামূল্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছি। তবে এই প্রয়াসগুলো সাময়িক সমাধান, কারণ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি এখন এক অপরিহার্য ঘাটতিতে পরিণত হয়েছে। এ সংকট সমাধানে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। চা শ্রমিক পরিবারগুলো সবচেয়ে অবহেলিত। এদের সন্তানেরা প্রাথমিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এটা কেবল সামাজিক নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাও।” সরকারি তথ্যমতে, চা বাগানভিত্তিক শিশুরা জাতীয় শিক্ষার হার থেকে অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার হার ৩০%–এর নিচে, আর মেয়েশিশুদের ঝরে পড়ার হার ৫০%–এর বেশি। চা বোর্ডের অধীন কয়েকটি স্কুল থাকলেও সেখানে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, পাঠ্যবই বা মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা। চায়ের কাপে সুবাস থাকলেও, সেই পাতা তুলে আনা শিশুর জীবনে নেই শিক্ষার আলো। এই বৈষম্য ভাঙতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা এবং অবিলম্বে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপনের বাস্তব পদক্ষেপ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category