• বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০৮ পূর্বাহ্ন

স্বামীর আসন পুনরুদ্ধারে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ইলিয়াসপত্নী লুনা, সালমাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর তৃণমূল বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার / ২৫ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

ব্যস্ত রাজনীতিবিদের জীবনসঙ্গী হিসেবে তাদেরও ব্যস্ততা ছিল। তবে তা ছিল অন্তরালে। বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া তাদের দেখা যেত না। অন্তরালের সেই রুটিন পুরোটাই পাল্টে গেছে স্বামীর অবর্তমানে। নিজেদের এতটাই বদলে দিয়েছেন যে, রাজনীতির মাঠ চষে পরিবারও সামাল দিচ্ছেন। এতে করে দৃশ্যপটে না থেকেও স্বামীর রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান রয়েছে।

রাজনীতির মাঠে নিজেদের এভাবেই নিবেদিত করে রেখেছেন সিলেট অঞ্চলে ভোটের রাজনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই রাজনীতিবিদের স্ত্রীরা। তাদের একজন তাহসিনা রুশদীর লুনা। তিনি সিলেট-২ নির্বাচনি এলাকার বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী। অন্যজন সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনি এলাকার একাধিকবারের সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেনের স্ত্রী সালমা আক্তার।

ইলিয়াস আলী বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত একটি নাম। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গাড়িচালকসহ তিনি ‘গুম’ হন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। রাজনীতিবিদ স্বামীর অবর্তমানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তাহসিনা রুশদীর লুনা তার নির্বাচনি এলাকায় রাজনৈতিকভাবে তৎপর রয়েছেন। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন।

রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে স্বামীর আসনে (সিলেট-২, বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচন কমিশন অযাচিতভাবে তার প্রার্থিতা বাতিল করে। অভিযোগ ছিল, আওয়ামী লীগের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে রুশদীর লুনার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।

এদিকে, হাওরাঞ্চলের আসনখ্যাত সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধরমপাশা-মধ্যনগর) নির্বাচনি এলাকার একাধিকবারের সংসদ সদস্য নজির হোসেন ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তার অকস্মাৎ মৃত্যু নির্বাচনি এলাকায় দলমতনির্বিশেষে মানুষকে শোকাহত করে। এই পরিস্থিতিতে, সালমা আক্তার, যিনি ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর জীবন যাপন করছিলেন, তিনি মাঠে তৎপর হন।

এলাকাবাসী জানান, গত এক বছরে দলের তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মন জয় করায় সালমা আক্তার এখন ‘সালমা নজির’ নামে পরিচিত। জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে তৃণমূলে বিএনপি পুনর্গঠনে সালমা তার স্বামীর নির্বাচনি এলাকার একটি উপজেলা কমিটির সদস্য পদেও আসীন হয়েছেন।

গণমুখী হতেই ‘গুম’
ছাত্রাবস্থা থেকে সাহসী চরিত্রের ইলিয়াস আলী বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আবাসিক হলের নেতা থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হন। ১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কাউন্সিলে আন্তর্জাতিকবিষয়ক সচিব নির্বাচিত হন। আশির দশকের মধ্যভাগে রাজধানীতে ছাত্ররাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ইলিয়াসই প্রথম সেই সময়কার সামরিক শাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ জন্য ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হন।

১৯৮৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে সাত মাস কারাভোগ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আবার কারাবন্দি হন। ২৩ মাস কারাভোগের পেছনে ছিল অন্তর্দলীয় ষড়যন্ত্র। তা ভেদ করেন কারামুক্তির মধ্য দিয়ে। তখন বয়সে তরুণ হলেও মূল দলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত ইলিয়াস ভোটের রাজনীতিতে নেমেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন। এরপর ২০০৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তার সমর্থকদের অভিযোগ ছিল, ‘ওয়ান-ইলেভেন ষড়যন্ত্রে’ তাকে হারানো হয়। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ তাকে তুলে নেওয়া হয়। সেই থেকে তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি।

ইলিয়াস আলী সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পাশাপাশি সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। তার সাংগঠনিক দায়িত্বে সিলেটে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যে সমাবেশ হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশে পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি উত্থাপন করে ইলিয়াস ভারতের আগ্রাসী তৎপরতার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানান। এরপর সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে ভারতের টিপাইমুখের বাঁধবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনে সম্পৃক্তরা বলেছেন, এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় ইলিয়াসও গণমুখী হয়ে উঠেছিলেন। গণমুখী হতেই তিনি ‘গুম’ হন।

রাজনীতির বিজ্ঞজন নজির হোসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত নিয়ে পড়াশোনা শেষ করা নজির হোসেন ভূ-রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করতে ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সেখানে তিনি ১৮ মাস ছিলেন। এর আগে ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিলেট জেলা (বর্তমানে বিভাগ) ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘সুনামগঞ্জ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’-এর সহ-সম্পাদক ও যুদ্ধ চলাকালে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের সহ-অধিনায়কের (বেসামরিক) দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৫ সালে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে হাওরে ভাসান পানির আন্দোলন সংঘটিত করে ৬ মাস কারাবরণ করেন। ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় তিন জোটের রূপরেখা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিলেন।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নজির হোসেন সুনামগঞ্জ-১ আসনে প্রথম নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৩ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে এ দুটো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারার জন্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ভোটাধিকার হরণকে দায়ী করেন তার সমর্থকরা।

রাজনীতির বিজ্ঞজন হিসেবে সমাদৃত ছিলেন নজির হোসেন। মোট পাঁচবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সর্বশেষ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ানখ্যাত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। ভোটের রাজনীতিতে সেই হারজিৎ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বলা হয়েছিল ‘নজিরের নজিরবিহীন বিজয়’। বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাংগঠনিক দক্ষতার জনপ্রিয়তায় তিনি দলীয় কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

মাঠের দৃশ্যপট
‘সিলেটের সঙ্গে আমি রক্তঋণে আবদ্ধ!’ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় ইলিয়াস তার সিলেটের প্রতি টান এভাবেই প্রকাশ করতেন। দলীয় রাজনীতির বাইরে সর্বশেষ আন্দোলনও ছিল নিজ এলাকার জন্য। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ইলিয়াসের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (এপিএস) দায়িত্ব পালন করা ময়নুল হক বলেন, ‘আন্দোলনটি সিলেট থেকে বাংলাদেশের সমগ্র ভাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর স্বতঃস্ফূর্ত একটি হরতাল পালনের পর ছয় মাসের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এ কর্মসূচি আর শেষ করতে পারেননি। তাকে গুম করে আন্দোলনটিও নস্যাৎ করা হয়। মানুষ বলছেন এ আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ২০১২ সালেই জুলাই-বিপ্লবের মতো একটা কিছু ঘটত, ১২ বছর আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হতো।’

এদিকে, সুনামগঞ্জ-১ আসনটি সিলেট বিভাগের ১৯ আসনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সম্পদশালী। নজির হোসেন তার নির্বাচনি এলাকাকে বাংলাদেশে ‘হাওরের রাজধানী’বলে উপস্থাপন করতেন। জলাভূমির জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বড় বড় জলমহাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে গৎবাঁধা উন্নয়নের বিপরীতে তার ছিল গণমুখী ভাবনা।

উদ্ভাবনী উন্নয়নচিন্তার বাস্তবায়নে বিকল্প মেলেনি বলে এলাকাবাসী সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেনকে ভুলতে পারছে না বলে জানিয়েছেন তার এপিএসের দায়িত্ব পালন করা আব্দুল কাদির। তিনি বলেন, ‘নৌ-বাণিজ্যের জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে প্রসিদ্ধ জাদুকাটার জলমোহনায় বাংলাদেশের প্রথম নৌ-স্থল পথ সুবিধার বন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। এটি বাস্তবায়নে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তৎপর ছিলেন। স্থানীয় সম্পদ ও লোকবলকে কাজে লাগিয়ে প্রচলিত উন্নয়নের বাইরে নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল। এ জন্যই তার নির্বাচনি এলাকার টাঙ্গুয়ার হাওর বিখ্যাত হয়েছে। যদিও এই হাওর ব্যবস্থাপনায় তার মতামত এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

দুই এলাকা ঘুরে জানা গেছে, নিজেদের নির্বাচনি এলাকায় ইলিয়াস আলী ও নজির হোসেনের শূন্যতাকে ‘টান’ হিসেবে দেখছেন এলাকাবাসী। তা মেটাতেই মাঠে তৎপর লুনা-সালমা। রাজনীতিবিদ স্বামীর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়েও রাজনীতির মাঠে আলোচনা রয়েছেন। তবে এ নিয়ে তারা নীরব। দুই এলাকায় দুজন সম্পর্কে এলাকাবাসীর ভাষ্য, ‘এলাকার টান আর স্বামীর টান থেকেই মানুষের খোঁজ-খবর নিতে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন তারা। তাদের এ ভূমিকায় ভোটের রাজনীতিতে না থেকেও আলোচনায় আছেন ইলিয়াস-নজির।’

লুনা-সালমা রাজনীতির মাঠে থাকা দলের জন্য বাড়তি পাওয়া বলে মনে করেন সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনমুখী, উন্নয়নমুখী ও এলাকামুখী রাজনীতিবিদ হিসেবে তাদের প্রতি এলাকার মানুষের বিশেষ টান রয়েছে। এই টান বংশপরম্পরায় টিকে থাকুক, এটা সবার চাওয়া।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category