• সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৪:০৯ পূর্বাহ্ন

আঁধারেই থেকে যাচ্ছে চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা জীবন

স্টাফ রিপোর্টার / ৭ Time View
Update : বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫
আঁধারেই থেকে যাচ্ছে চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা জীবন
আঁধারেই থেকে যাচ্ছে চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা জীবন

 

আঁধারেই থেকে যাচ্ছে চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা জীবন

চা শ্রমিক মায়ের মেয়ে শ্রাবণী বাউরী (৯) পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। প্রতিদিন প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় তাকে। স্কুলব্যাগ নেই,পলিথিন ব্যাগ, পুরনো একটি খাতা আর ছেঁড়া বই-ই তার সঙ্গী। শ্রাবণী জানায়, আমার বই ছিল না, পাশের আপু বই দিলে পড়ি। মাস্টারমশাই কইছে খাতা লাগবো, মা কয় পয়সা নাই।

আরেক শিক্ষার্থী বিকাশ তিরকি (১২), পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বিকাশের বাবা-মা দুজনেই বাগানে কাজ করেন। স্কুলে নিয়মিত যেতে চাইলেও বই আর খাতার অভাবে পিছিয়ে পড়ে তার শিক্ষা জীবন । সে বলে
মাস্টারসাব কইছে হোমওয়ার্ক করতে, কিন্তু আমার খাতা ফুরাইয়া গেছে। আম্মা কয়, আগে ভাত খাই, খাতা পরে আনুম।

চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭৮ টাকা। এই আয়ে সংসার চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে সন্তানদের জন্য খাতা-কলম, ইউনিফর্ম বা স্কুলব্যাগ কেনা যেন বিলাসিতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায় স্কুলে ভর্তি শিশুর হার বাড়লেও, তাদের ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক হারে বেশি।

সিলেটের চা-বাগানগুলোর নরম সবুজ পাতার ছায়ায় প্রতিদিন শুরু হয় হাজারো শ্রমিকের জীবনের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে সবচেয়ে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা জীবন।

পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ না থাকায় তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারে না অনেক সময়।

চা বাগানের শিশুদের শিক্ষার অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্থানীয় এক যুব সংগঠক সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকটি স্কুল থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ তো দূরের কথা, অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বোর্ড মার্কার বা চক পর্যন্ত নিজে কিনে আনতে হয়। এমনও দেখা যায়, কেউ কেউ খালি হাতে স্কুলে আসে না থাকে খাতা, না কলম।

তিনি আরও বলেন, সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঝে মাঝে সহায়তা নিয়ে এলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। স্থায়ী কোনো ব্যবস্থার অভাবে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শিশুদের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে নিয়মিত সহায়তা এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ, মদন মোহন কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন, উপকরণবিহীন কোনো শিক্ষা কার্যক্রমই টেকসই হতে পারে না। শিশুরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা। অথচ শিক্ষা উপকরণের অভাবে যদি চা বাগান এলাকার একটি বড় জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ থমকে যায়, সেটি কোনো সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়। এখনই প্রয়োজন চা বাগান এলাকায় বসবাসরত শিশুদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং বাস্তবমুখী ও টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করা।”

সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সহায়তা না মিললেও কিছু বেসরকারি সংস্থা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে, তবে তা মোটেই প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো) এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, সিলেট সদর উপজেলার লাক্কাতুরা ও দলদলি চা-বাগানে চা-শ্রমিক শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে একডো ২০১৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ওই দুই বাগানে দুটি এডুকেশন সাপোর্ট সেন্টার চালু করা হয়েছে, যেখানে শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষাভাষী একজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পাঠদানে সহায়তা করা হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সাল থেকে একডো চা-শ্রমিক ও পাত্র জনগোষ্ঠীর ৩০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মাসিক শিক্ষা সহায়তা প্রদান করছে।

লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের এ সহায়তা খুবই অপ্রতুল। তাই আমি সরকারসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়নে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে।

এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা IDEA এর ECETG প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী সুদীপ্ত চৌধুরী বলেন, চা-বাগানের শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতেই আমাদের এই উদ্যোগ। সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জৈন্তাপুরের ১২টি বাগানভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, বিদ্যালয় সংস্কার, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, খেলার সামগ্রী ও লাইব্রেরি স্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আমরা অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও এসএমসি সক্রিয়করণের মাধ্যমেও শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে কাজ করছি। এই প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য Childaid Network, Germany-কে ধন্যবাদ জানাই।”

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা উপ-পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রতিবছর প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণের উদ্দেশ্যে ১০ হাজার টাকা এবং শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য ‘স্লিপ ফান্ড’-এর আওতায় ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এই বরাদ্দের মূল লক্ষ্য হলো শিশুরা যেন প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী ও সহায়ক পরিবেশে পাঠ গ্রহণ করতে পারে। তাই নীতিগতভাবে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি থাকার কথা নয়। তবে কোথাও যদি এ ধরনের ঘাটতির অভিযোগ উঠে, তাহলে তা বরাদ্দের অভাব নয়, বরং বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার ফল হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিয়মিত তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যেন দেশের প্রতিটি শিশুই সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ পায় এবং প্রকৃত অর্থে উপকৃত হতে পারে।”

এ বিষয়ে ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের সদস্য আতাউর রহমান শামিম বলেন,

চা বাগান এলাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু এনজিও কখনো কখনো শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ বা বিদ্যালয় মেরামতের মতো কিছু কার্যক্রম চালায়, তবে তা একেবারেই সীমিত এবং অধিকাংশ বাগানে এই সহায়তা পৌঁছায় না। মাধ্যমিক পর্যায়ে তো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ফলে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ে এই স্তরেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরে এখন প্রয়োজন টেকসই, বিস্তৃত এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ। বর্তমান সহায়তা একদিকে যেমন অপ্রতুল, অন্যদিকে অধিকাংশ জায়গায় তা সঠিকভাবে পৌঁছায় না। অথচ চা শ্রমিক পরিবারের শিশুরাও এই দেশেরই ভবিষ্যৎ। তাদের জন্যও সমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে শুধু দয়া নয়, এটি তাদের প্রাপ্য অধিকার।”

শিশুরা ভবিষ্যতের নির্মাতা। অথচ শিক্ষা উপকরণের অভাবে যদি একটি জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ থমকে যায়, তা কোনো সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়। এখনই প্রয়োজন চা বাগান এলাকায় বসবাসরত শিশুদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বাজেট ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category