চল্লিশ হাজার একর রেকর্ডি ও সরকারি খাস জমিতে পাকতে শুরু করেছে আমন ধান। বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে মেঘনার চরের এসব ধান আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাটা শুরু হবে। চরের এই ধান নিজেদের দাবি করে মহড়া দিয়ে জনসমর্থন ভারি করতে নেমেছেন দুই উপজেলার বিএনপি নেতারা। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনও পড়েছে বিপাকে।
স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, ৮০’র দশক থেকে মেঘনার ভাঙনের কবলে পড়ে হিজলা উপজেলার ধুলখোলা ও হিজলা গৌরব্দী ইউনিয়নের একটি অংশ এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। ২০০০ সাল পরবর্তী উভয় এলাকায় আবার চর জাগতে শুরু করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে ওই চরে আধিপত্য বিস্তার করে দুই উপজেলা বিএনপির নেতারা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি নেতারা চর থেকে বিতাড়িত হন। আর তা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে। গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর এখন দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের বিএনপি নেতারা।
দুই উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভোলা, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলার সীমান্তবর্তী বরিশালের দুই উপজেলার চারটি ইউনিয়ন। এই চারটি ইউনিয়নের তিনটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ জনপদ মেঘনা নদীর তলদেশ ও নতুন করে জেগে ওঠা চর। জেগে ওঠা চরের মধ্যে ৪০ হাজার একর জমিতে বর্তমানে চাষাবাদ চলছে। তার মধ্যে ২০ হাজার একর রেকর্ডি বাকি ২০ হাজার একর সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর এই জমি নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার বিএনপি নেতারা। রেকর্ডি জমির মালিকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই উপজেলার নেতাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
সম্প্রতি হিজলা থানা পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে চরের জমি মেপে বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করা হয়। হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল গাফফার তালুকদারের উদ্যোগে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রেকর্ডি জমির মালিকরা অভিযোগ করেন, আমাদের পৈত্রিক জমিতে যেতে বাধা দিচ্ছেন মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজান মাঝি ও তার সহযোগীরা। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিজান মাঝি। তিনি বলেন, চরে আমার পৈত্রিক জায়গা-জমি থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সেখানে যাইনি। তবে প্রকৃত মালিকদের জমি বুঝিয়ে দিতে চাই।
হিজলা গৌরব্দী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গাফফার তালুকদার এখন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, আমার পৈত্রিক বাড়িসহ হাজার হাজার মানুষের একসময় বসতি ছিল চরে। কাউকে শক্তি দিয়ে অন্যের জমি ভোগ-দখল করতে দেওয়া হবে না। রেকর্ডি মালিকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া আমার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এদিকে গত বুধবার মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চরে বসবাসকারী রেকর্ডি জমির কয়েকশ মালিক পাল্টা মানববন্ধন করেন। সেখানে তারা বিএনপি নেতা আব্দুল গাফফার তালুকদারকে ভূমিদস্যু আখ্যা দিয়ে তার বিচার দাবি করেন। কৃষক আ. ছত্তার মাঝি বলেন, আমার পৈত্রিক বাড়িঘর মেঘনায় বিলীনের পর আবার জেগে উঠেছে। বিগত দিনে জমি দখল করে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। গত সপ্তাহে বিএনপি অফিসে আমাদের ডেকে জমির ধান কাটতে নিষেধ করে গেছেন বিএনপি নেতা গাফফার তালুকদার।
হিজলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসীন সাদেক বলেন, সীমান্তের জমি নিয়ে বরিশালসহ চার জেলার সমন্বয়ে পরিমাপ হলে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম মশিউর রহমান বলেন, বিরোধীয় চরে উভয় উপজেলার জমি রয়েছে। তবে হিজলার লোকজনের দাবি করা জমির প্রকৃত মালিক মেহেন্দিগঞ্জের লোকজন।
বরিশালের পুলিশ সুপার মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, চরের জমিতে আমন ধান কাটা নিয়ে কোনো আশঙ্কার কথা কেউ জানায়নি। এমন আশঙ্কা থাকলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দুই উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে বিরোধ নিষ্পত্তিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসেন।
বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ার মো. শহীদুল্লাহ বলেছেন, দলের নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ প্রকৃত জমির মালিকদের ধানসহ অন্যান্য ফসল নিয়ে যায়; অবশ্যই তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।