চিরচেনা রূপে নেই বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ। শিক্ষকদের নেই কোন কর্মব্যস্ততা। শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার জন্য নেই কোন তাড়াহুড়ো। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে আসলেও শ্রেণিকক্ষে গিয়ে পাঠদান থেকে বিরত রয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ। যেখানে বসে প্রতিদিন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাঠ্যবই থেকে নির্দিষ্ট পাড়াগুলো বুঝিয়ে দেন একজন শিক্ষক। সেগুলো আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শ্রেণিকক্ষে থাকা শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত চেয়ার টেবিল আজ রয়েছে রয়েছে ফাঁকা। কারণ একটাই নিজেদের প্রাপ্ত সম্মান এবং সম্মানীর দাবিতে শিক্ষকরা রয়েছেন কঠোর আন্দোলনে। শিক্ষকদের দাবি আদায় না হওয়ায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন বিয়ানীবাজার উপজেলার ১৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৮ শতাধিক শিক্ষক। ৩ দফা দাবীতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এবার কঠোর কর্মসূচি পালন করছেন বিয়ানীবাজার উপজেলার সহকারী শিক্ষকরা। এর আগে এক ঘন্টা, পরবর্তীতে ২ ঘন্টা এবং সর্বশেষ গতকাল রবিবার পর্যন্ত একটানা অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের কঠোর কর্মসূচি চলবে বলে জানান বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতারা। এবার পেছনের সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে সব শিক্ষক নেতারা ঐক্যবধ্য ভাবে দাবি আদায়ে কর্মসূচি পালন করছেন।
জানা যায়, সহকারী শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আহবান করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। কয়েক ঘন্টা ব্যাপি সেই বৈঠকে উপস্থিত হয়ে শিক্ষক নেতারা তাদের দাবির প্রতি অনড় থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর থেকে নতুন করে শিক্ষকদের চাওয়া ১১তম গ্রেড নির্ধারণ করে বাজেটসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে প্রস্তাবনাটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন এর অপেক্ষায় রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সামছুদ্দীন্ন মাসুদ জানান, আমরা চাই না কঠোর কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে যারা আছেন তারা আমাদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারছেন না। আমাদের সম্মানের কথা চিন্তা করছেন না। সেজন্য বাধ্য হয়ে আমাদেরকে কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। যত সময় পর্যন্ত সরকার আমাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি না করবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের কঠোর কর্মসূচি চলমান থাকবে। মৌখিক আশাসে আমরা আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো না।
জানা গেছে, ১১তম গ্রেডে বেতনসহ তিন দফা দাবিতে সারা দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা টানা কর্মবিরতি পালন করার ঘোষণা দেন। তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করেছেন মাঠ পর্যায়ের দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষকরা।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের ব্যানার এ কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষকরা নির্ধারিত সময়ে বিদ্যালয়ে আসলেও শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে বিরত রয়েছেন। তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করায় শিক্ষার্থীরা পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা সময়মতো বিদ্যালয়ে আসলেও কোন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যাননি। বিগত দিনে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ঢিলেঢালা ভাবে কর্মসূচি পালিত হলেও বর্তমানে তারা কঠোর অবস্থানে থেকে তাদের নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করছেন। অতীতে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্মবিরতি পালন না করলেও সময়ের সাথে সাথে সেইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা দাবি আদায়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল আমীন বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের পেছনে ফেরার আর কোন সুযোগ নেই। সরকার অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি মেনে নিলেও আমাদের দাবি মানতে বিভিন্ন অযুহাত খুঁজে বের করছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তুলার মুল ভিত্তি স্থাপন যারা করছে সেই প্রাথমিক কারিগরদের অসম্মান করে জাতি সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। যতদ্রুত সম্ভব সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবেন বলে আমরা মনে করছি।
বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু তালুকদার বলেন, বৈষম্য নিরসনে যে সরকার কাজ করার কথা সেই সরকার যদি প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে বৈষম্য করে তাহলে এর চেয়ে বেশি কষ্টের আর কিছু হয় না। আমারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে জাতিকে শিক্ষিত করে তুলার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করছি বিনিময়ে আমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে এর থেকে বড় বৈষম্য আর কি হতে পারে।
উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আলী হোসেন মুন্না বলেন, আমরা কোন অন্যায় কিংবা অযৌক্তিক দাবি নিয়ে কর্মসূচি পালন করছি না। আমরা নিজেদের পরিবার নিয়ে সুন্দর ভাবে বেচে থাকার জন্য আন্দোলন করছি। আমাদের প্রাপ্ত সম্মানের সাথে সম্মানিটাও যেন সম্মানজনক হয় সেই দাবি আদায়ের কর্মসূচি পালন করছি। আমাদেরকে যে বেতন দেওয়া হয় সেটা দিয়ে ভালো মতো বাচার কোন উপায় নেই। তাই এবার মৌখিক আশাসে আমরা দাবি আদায়ের কর্মসূচি পালন থেকে সরে আসবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার দাবি মেনে নিয়ে লিখিত ব্যাবস্থা গ্রহণ না করবে ততদিন পর্যন্ত আমরা কর্মসূচি পালন করে যাবো।
শিক্ষকদের দাবিগুলো
তিন দফা দাবি
১. সরকারের গঠিত কনসালটেশন কমিটির সুপারিশের যৌক্তিক সংস্কার করে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ।
২. ১০ বছর ও ১৬ বছরপূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন।
৩. প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতিসহ দ্রুত পদোন্নতি প্রদান।