• বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৬ পূর্বাহ্ন

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বীরাঙ্গনার খেতাব পাননি সখিনা খাতুন

ডেস্ক রিপোর্ট / ১১৬ Time View
Update : রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বীরাঙ্গনা খেতাব পাননি বয়োবৃদ্ধ সখিনা খাতুন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্যাতিতা এই নারী এখন মেয়ের কাছে দিন কাটাচ্ছেন। এত বছর পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবুও বীরাঙ্গনা খেতাব পেলেন না কেন? এমন প্রশ্ন স্থানীয়দেরও।

সরেজমিনে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাঁকখালী গ্রামের সখিনা খাতুনের স্বামী বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। ফলে বীরাঙ্গনার খেতাব চেয়ে আবেদন করেও পাননি স্বীকৃতি। ৪ বছর বিভিন্ন অফিসে ঘুরপাক খায় তার ফাইল। তবুও মেলেনি খেতাব। পরিবারের সদস্যদের সামনে বরং এক কর্মকর্তার প্রশ্নবাণে অপমানিত হতে হয়েছে ৭৮ বছর বয়সী এই নারীকে।

২০২০ সালে সখিনা খাতুন বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আবেদন করেন। সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগমের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করলে গত চার বছর ধরে ফাইলটি নিজের হাতে রেখে দেন এই নারী কর্মকর্তা। এ ছাড়াও তদন্তের নামে লুৎফুন নেছা তাকে তার পরিবারের সদস্যদের সামনে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে অপমান করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সখিনা বেগমের বড় মেয়ে মোহছেনা বেগম এ প্রতিবেদককে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে আমার মা বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। আবেদন সঠিক হলে আমার মা স্বীকৃতি পাবেন, অন্যথায় নয়। এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কীভাবে আমার মাকে অশালীন ভাষায় আপত্তিকর প্রশ্নে বিব্রত করেন। তাও আমার বাবা এবং আমরা চার (মেয়ে) সন্তানের সামনে। অপমান সইতে না পেরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সখিনা খাতুনের আরেক মেয়ে জাহেদা বেগম বলেন, ‘বাবা বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে এবং ঘুষ না দেওয়ায় মাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হয়েছে। সমাজসেবা অফিসারের অভদ্র এবং বিশ্রী প্রশ্নে ভারাক্রান্ত হয়ে স্বামী এবং চার কন্যার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমার বাবা জামাল উল্লা ১৯৯১-২০০৩ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ছিলেন। তিনি বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এই বীরত্বের সম্মাননা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন আমার মা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার মাকে তার বীরত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।’

আরেক মেয়ে সাজেদা বেগম বলেন, “ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মা কখনো ঘর থেকে বের হননি। যখনই বের হতেন প্রতিবেশীরা যুদ্ধের সময় নির্যাতন সম্পর্কে অনেক কটু শোনাতেন। এমনকি স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের ‘পাঞ্জাবি মেয়ে’ বলে অপমান করত অনেকে। আমরা এই শব্দের অর্থ বুঝতে পারতাম না। আমি বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করতাম। তখন বাবা কিছু না বলে চুপ করে থাকতেন আর মা নীরবে কাঁদতেন। পরে যখন আমরা এটা বুঝতে পারি, তখন আমরা স্কুলে যেতে চাইতাম না। শিক্ষকরা বাড়িতে এসে আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। এ ছাড়া শিক্ষক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বারবার গ্রামের সবাইকে এই শব্দ ব্যবহার না করতে নিষেধ করতেন।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফখরুল ইসলাম (৭৭) বলেন, ‘সখিনা খাতুন মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয়েছিলেন, এটা দিবালোকের মতো সত্য। আমি এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমরা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে এটি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তিনি আবেদনটি আটকে রাখেন। সবার সামনে আমাকেও তিনি বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। একপর্যায়ে যখন বললাম, আমরা যুদ্ধের সময় আপনার নানাকে মারতে গিয়েছিলাম। সেই সময় তিনি জানালা দিয়ে পালিয়ে যান। (তার নানা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন) মাকে জিজ্ঞেস করলেই ঘটনা জানতে পারবেন। তারপর চুপ হয়ে যায় এই নারী কর্মকর্তা।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মুনসুর বলেন, ‘এটা শতভাগ সঠিক যে সখিনা খাতুন মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত হয়েছিলেন। ২০২০ সালে তিনি যখন বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী সরকার। প্রকৃত ঘটনা জানা সত্ত্বেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা লিখিত সাক্ষ্য দিতে সাহস পাননি। আমি এবং আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লিখিত সাক্ষ্য দিয়েছি।’

সখিনা খাতুনের বাড়ির পাশে বসবাসকারী মুক্তিযোদ্ধা আমিরুজ্জামান (৮৫), রফিউজ্জামান (৭৫), জেবল হোসেন (৮৮), ফখরুল ইসলাম (৭৭) ও অন্যরা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় সখিনা খাতুন নির্যাতনের শিকার হন। এই ঘটনার অনেক সাক্ষী আছে। আমরা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিয়েছি।

এ বিষয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আমি নিজে একজন নারী হয়ে অন্য নারীকে অপমান করার প্রশ্নই আসে না। একজন সাক্ষীও না পাওয়ায় সখিনা বেগমের আবেদনপত্র আটকে যায়।’ কিন্তু এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সেখানে হাজির হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মুনসুর। তিনিসহ দুই মুক্তিযোদ্ধা জবানবন্দি দেন। তখন সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগম বলেন, এ দুজন ছাড়া আর কোনো সাক্ষী ছিল না।

বীরাঙ্গনার দাবি সত্য নাকি মিথ্যা, রিপোর্ট মন্ত্রণালয় পাঠাননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল ইসলাম ও কাজী সিরাজ সেসময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতেন। আমরা শুধু ফর্মালিটি মেইনটেন করতাম। ওনারা নিষেধ করাতে এটা নিয়ে কিছু করার ছিল না।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category