অন্তঃসত্ত্বা ও অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন রাকিব। কিন্তু ওষুধ নিয়ে আর ফিরতে পারেননি তিনি। পরিবার পেল শুধু লাশ। ময়মনসিংহে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন কোরআনের হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২১)। নববধূ স্ত্রী সাদিয়া আক্তারের হাতের মেহেদি মোছার আগেই শহীদের স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পেলেন তিনি। কিন্তু অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না সাদিয়ার। অপরদিকে নববধূ সাদিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত গোটা পরিবার।
সাদিয়া আক্তার জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি অসুস্থতায় ভুগছিলেন। যে কারণে ২০ জুলাই সকালে তার জন্য ওষুধ আনতে গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারে গিয়েছিলেন রাকিব। তখন কলতাপাড়া বাজারে
ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এ সময়ে তিনি মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন। আর তখনই পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাকিব। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও বলেন, সংসারের হাল ধরার মতো রাকিব ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।
রাকিবের মা নুরুন নাহার। তার বয়স ৫৬। তিনি ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে রাতে ফিরে তিনি আর ছেলের মুখ দেখতে পাননি।
রাকিবের বাবা আব্দুল হালিম গৌরীপুর উপজেলার দাওগাঁও তালিমুল কোরআন মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক। তিনি জানান, ছেলের মৃত্যুর পর পুরো পরিবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অনাগত অতিথির জন্য তিনি উদ্বিগ্ন। সাদিয়া ও তার গর্ভে থাকা সন্তানের কী হবে, কী করবেন বা কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘স্বামীর শোকে পাথর হয়ে গেছে সাদিয়া। সারাদিনই কান্নাকাটি করে, ওর মুখের দিকে তাকানোই যায় না। দেখলেই কলিজাটা খান খান করে হয়ে যায়।’
রাকিবের বাবা আরও জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিব ছিলেন তার একমাত্র ছেলেসন্তান। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ছেন। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রাকিবকে বিয়ে করান পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পলাশকান্দা গ্রামে। পুত্রবধূ সাদিয়া আক্তারও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী। সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রাকিবের কণ্ঠস্বর খুবই ভালো ছিল। ভিডিও করা তার শখ ছিল। তার ফেসবুক আইডি আছে। সেখানে গজল গেয়ে আপলোড করত। অনেক আশা ছিল রাকিব সংসারের হাল ধরবে। বংশের বাতি হয়ে আলোকিত করবে। এখন তো সবই শেষ হয়ে গেল। বংশের বাতিটাইতো নিভে গেল।
আব্দুল হালিম আরও জানান, ঘটনার দিন রাকিবের মাকে নিয়ে তিনি এক আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আত্মীয়বাড়িতে থাকাবস্থাতেই রাকিব গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান। রাকিবের বুকের বাম দিকে ছিদ্র ছিল। রাকিব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন খবর পেয়ে তার মা সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারান। তাকে হাসপতালে নিয়ে যাওয়া হলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ভর্তি করার পরামর্শ দেন। এদিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার কারণে রাকিবের মরদেহ দাফনের ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল আল আমিন জনি দ্রুত দাফন করতে নির্দেশ দেন। এমনকি জানাজার জন্য মাইকিং করতেও বারণ করেন তিনি। এদিকে ইউপি চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুতই রাকিবের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। রাত ১০টার দিকে রাকিবের মা হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, ছেলের মরদেহ দাফন হয়ে গেছে।