ধান ও লিচুর জেলা নামে পরিচিত দিনাজপুর হলেও এই জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার একটি ইউনিয়নের আমডুঙ্গীহাট থেকে প্রতিদিন পাইকারি বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার আলু। বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কোটি টাকার আলু চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
প্রতিদিন সাত সকাল থেকে আলু তোলায় ব্যস্ত গ্রামের নারী-পুরুষ। আর এসব আলু কিনতে পাইকাররা ছুটে যান প্রতি এলাকায় আলু ক্ষেতে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আলু ক্ষেত থেকে সারাদিন আলু কিনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আলুগুলো নিয়ে আসে উপজেলার শিবনগর ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত ছোট যমুনা নদীর পাড়ের আমডুঙ্গী হাটে। পার্শ্ববর্তী উপজেলার পার্বতীপুরের শিয়ালকোট, যশাই, জুড়াই এলাকা থেকেও আলু আসে এই হাটের পাইকারদের কাছে। এখানে নদীর হিমশীতল জলে আলু পরিষ্কার করে বস্তায় ভরেন অর্ধশাধিক মৌসুমি শ্রমিক। ধোয়া আলু বস্তায় ভরে ওজন দেওয়ার পর ট্রাকে লোড হয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নাটোর, পাবনা ও রাজশাহী জেলায়।
ওইসব এলাকা সরজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিবনগর ইউনিয়নসহ আশপাশের ইউনিয়নের গ্রাম এবং পার্বতীপুর পাশের উপজেলা পার্বতীপুরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আলু চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি মাঠ থেকে প্রতিদিন আগাম জাতের ৫ থেকে ৬ হাজার মণ আলু কিনেন এলাকার ৮-১০ জন পাইকার। পাইকারদের মতে, এই আলুর পাইকারি মূল্য কোটি টাকার অধিক। তাদের হিসাব অনুযায়ী প্রতি ট্রাকে আলু যায় ২০০ থেকে ২৫০ বস্তা। অর্থাৎ, একটি ট্রাকে ৬০ কেজির ২৫০ বস্তা আলুর দাম ৫০ টাকা টাকা হিসেবে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে আমডুঙ্গী হাট থেকে ১০-১২টা এবং হাটের ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে শমশেরনগর, পাঠাকপাড়া, চোখারহাট থেকে আরও ৫-৭ ট্রাক আলু যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে গড়ে প্রায় কোটি টাকার অধিক দামের আলু চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কয়েকজন পাইকার জানান, ১১০ টাকা কেজি দরে আলু কেনা শুরু করেছিলেন তারা। বর্তমানে জাতভেদে ওই আলু ৪৮ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে কিনছেন। তবে প্রথম দিকে আগাম জাতের আলু দুয়েক ট্রাক গেলেও বর্তমানে প্রতিদিনই ১২-১৫ ট্রাক আলু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাদের মতে, আর ১৫ থেকে ২০ দিন চলতে পারে আলুর এই মৌসুমি ব্যবসা।
চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন খরচ বেশি হলেও দাম ভালো পাওয়ায় খুশি এলাকার আগাম আলু আলু চাষিরা। তারা বলেছেন, মাঠে আমরা আমাদের শ্রমিক দিয়ে আলু তুলছি, এখান থেকেই পাইকাররা আলু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলেন, শুরুতে ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করলেও বর্তমানে ক্যারেজ আলু ৪৮ টাকা কেজি এবং রোমানা জাতের আলু ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমডুঙ্গীহাটে আলুর পাইকার লুৎফর রহমানের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, প্রতিদিন তিনি দুই ট্রাক আলু পাঠান টাঙ্গাইল ও রাজশাহীতে। আলু কিনছেন ক্যারেজ ৪৮ টাকা এবং রোমানা (লাল) ৫০-৫২ টাকা কেজি হিসেবে। আরেক পাইকার খাজানুর রহমান জানান, তিনি প্রতিদিন তিন ট্রাক আলু পাঠান। তিনি পাবনা জেলায় বেশি আলু পাঠান। নূর ইসলাম নামের এক পাইকার জানান, তিনি প্রতিদিন তিন ট্রাক আলু পাঠান। তিনি টাঙ্গাইল, মধুপুর, ময়মনসিং আলু পাঠান। বাদশা নামের একজন পাইকার বলেন, আলু কেনার ওপর নির্ভর করে আলু পাঠানো। তবে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ট্রাক আলু তিনি পাঠান ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকায়।
ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সামেদুল ইসলাম জানান, উপজেলার মধ্যে এই ইউনিয়নের আলুসহ বিভিন্ন ধরনের রবি শস্য চাষ হয় বেশি। প্রতি বছর ইউনিয়নে আমডুঙ্গীহাট থেকে আগাম আলু দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। প্রথম দিকে দুয়েক ট্রাক গেলেও ফুল পিক সিজন অর্থাৎ ডিসেম্বরের ১০ থেকে ২০ তারিখের দিকে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক ট্রাক আলু প্রতিদিন যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। বর্তমানেও প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক আলু যাচ্ছে। প্রথমদিকে ফুলবাড়ীর আলু বিক্রি হলেও এখন ফুলবাড়ীর উপজেলা পার্বতীপুর থেকেও এখানে আলু আসছে। তিনি বলেন, এখনও ২০ দিন এই আলুর বাজার চলবে। তিনি আরও বলেন, ফুলবাড়ীর এই আলুর বাজার স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আগাম জাতের আলুতে কৃষক ভালো দাম পেয়েছে, তাই কৃষক খুশি। এখনও আলু লাগাচ্ছে কৃষক। যদিও এখন রোপণকৃত আলু একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে তবুও দামের কারণে কৃষক আলু লাগাচ্ছে। দেরি হলেও মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত আলু লাগানো যায়। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর উপজেলায় ১ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে আলু লাগানোর লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়। তবে এখনও চূড়ান্ত হিসাব বলা যাবে না; কারণ কৃষকের আগ্রহ দেখে এবং মাঠের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, প্রায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হবে।