লালমনিরহাটের বড়বাড়ী হাটে বাঁশশিল্প এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা। এখানে অর্ধশতাধিক পরিবার বাঁশ থেকে তৈরি পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বাঁশের পণ্য যেমন- ডুলি, কুলা, চালুনি, খাঁচা ও ঝাড়ু বিক্রি করে তারা সংসার চালায়।
বড়বাড়ী বাজারে সপ্তাহে দুই দিন- শনি ও বুধবার বাঁশের পণ্য কেনাবেচা হয়। এখানে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশের পণ্য নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। শীতে গ্রামীণ এলাকাগুলোয় এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকে। তবে ক্রেতারা মনে করেন, এসব পণ্যের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। এমনকি একসময় বাঁশের পণ্য বাজারে পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
ক্রেতা আহাম্মদ আলী (৪০) জানান, তার বাড়ির ধানের ডুলি ভেঙে গেছে, তাই তিনি নতুন ডুলি ও মাটি কাটার ডালি কিনতে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বাঁশের পণ্য ব্যবহার করে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন প্লাস্টিকের পণ্য বেশি হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে বাঁশের পণ্য একদিন হারিয়ে যাবে।’
বাঁশের পণ্য বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। মাটি কাটার ডালি ৭০ থেকে ৯০ টাকা, বড় ডালি ৮০ থেকে ১৫০, ঝাড়ু ৪০ থেকে ৫০, কুলা ৮০ থেকে ১৫০, চাইলন ৬০ থেকে ৭০, মুরগির টোপা ১২০ থেকে ১৫০, কবুতরের খাঁচা ১২০ থেকে ১৮০, মাছ ধরার পলো ৩০০ থেকে ৩৫০ এবং মাছ ধরার ডাইর ২০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতা আব্দুল খালেক (৬৫) জানান, তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশের পণ্য পাইকারি কিনে এনে বাজারে বিক্রি করেন। প্রতিটি হাটে তিনি ১০-২০ হাজার টাকার পণ্য কেনেন। তা বিক্রি করে ২-৩ হাজার টাকা লাভ করেন। তিনি বলেন, ‘এখন বাজারে এসব পণ্যের বিক্রি ভালো চলছে।’
ইসমাইল হোসেন (৫০) নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আমি বাঁশের পণ্য কিনে গ্রামে বিক্রি করি। প্রতি হাটে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার পণ্য কিনি। এরপর তা বিক্রি করে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা লাভ হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্লাস্টিকের পণ্যের কারণে বাঁশের পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তবে আমরা এখনো এ ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল।’
বাঁশের পণ্য তৈরির কারিগর হযরত আলী (৪৮) বলেন, ‘একসময় গ্রামে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হতো। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে যুক্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে মূল্য বৃদ্ধি ও বাজারে বাঁশের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমাদের পণ্য বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
এ শিল্পের মূল উপকরণ বাঁশের দামও বেড়ে গেছে। এর ফলে অনেক গ্রামীণ কারিগর এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একসময় যারা এ শিল্পে যুক্ত ছিলেন, তারা বর্তমানে বেকার হয়ে পড়ছেন।
বড়বাড়ী হাটের ইজারাদার আলমগীর বাদশা বলেন, ‘এখন বাঁশের পণ্যের চাহিদা আগের মতো নেই। প্লাস্টিকের পণ্যের কারণে এসব পণ্য বাজারে কম বিক্রি হচ্ছে। আগে এখানে ৮০ থেকে ১০০টি দোকান বসত, এখন সেটা কমে ৩০-৩২টি হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় কারিগর ও ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। প্লাস্টিক ও অন্যান্য আধুনিক পণ্যের আগমনে বাঁশের পণ্যের কদর কমে গেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠেছে।
বাঁশশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো আশা করছে, যদি সরকারি বা স্থানীয় উদ্যোগে তাদের এ শিল্পকে সহায়তা করা হয়। তবে হয়তো তারা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে। তবে আগামী দিনগুলোতে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে এখনো অনেক সংশয় রয়ে গেছে।