প্রশাসনিক উদাসীনতা, অযত্ন আর অবহেলায় লক্ষ্মীপুরের গণকবরগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় বর্তমানে ১০টি গণকবর রয়েছে। এ উপজেলার চরচামিতা মীরা বাড়ির গণকবরের সমাধি চিহ্নগুলো উপড়ে ফেলে একটি শিল্পগ্রুপ তৈরি করেছে তাদের শ্রমিকদের থাকার শেড। দালাল বাজার বেলতলা গণকবরের ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রিজ গণকবরের ওপর চাষ করা হয়েছে মুলা। সদর উপজেলার জকসিন বাজারের উপকণ্ঠের শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কবরের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে তৈরি করা হয়েছে বাড়ির রাস্তা। লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়ি ঘটক কবরের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট ও বহুতল ভবন।
সদর উপজেলার পশ্চিম লতিফপুর নূর মিয়া মুন্সীবাড়ির গণকবরের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে পড়ে গেছে কয়েক বছর আগে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর এবং কাজীর দীঘিরপাড়ের গণকবর আজও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী মানুষের সমাধি চিহ্নগুলো বিলীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই গণকবরগুলো সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বারবার দাবি তোলা হলেও প্রশাসন তা আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার পশ্চিম লতিপুর নূর মিয়া মুন্সীবাড়ির গণকবরের সামনের সীমানাপ্রাচীর ও নামের ফলকগুলো ভেঙে পড়ে গেছে। এ বাড়ির বাসিন্দা শহিদ পরিবারের সন্তান আবির হোসেন ও টিটু জানান, এই বাড়িতে ১২ জন মুক্তিকামী মানুষের গণকবর রয়েছে।
বিগত সময়ে জেলা প্রশাসনের কাছে এসব গণকবর সংরক্ষণের জন্য নানা আবেদন-নিবেদন করেও কোনো ফল হয়নি। নিজস্ব উদ্যোগে কবরগুলোর পাশে সীমানা প্রাচীর এবং নামফলক স্থাপন করা হলেও ইতোমধ্যে তা ভেঙে পড়ে গেছে।
সদর উপজেলার চরচামিতা মীরা বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন ভোর রাতে পাকবাহিনীর সদস্যরা সংখ্যালঘুদের বসবাসকারী এই বাড়িতে হানা দেয়। সে সময় অনেকে পালিয়ে গেলেও বাড়িতে থাকা সাতজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে বাড়ির পাশের খালপাড়ে পরিবারের সদস্যরা তাদের কবরের ওপর পারিবারিকভাবে মঠ তৈরি করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। এক যুগ আগে তারা বাড়িটি একটি শিল্পগ্রুপের কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে যায়। পরে ওই কোম্পানি মঠগুলো ভেঙে গণকবরগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বর্তমানে এখানে রয়েছে একটি বড় ফ্যাক্টরি। গণকবরের জায়গায় ফ্যাক্টরিতে কাজ করা শ্রমিকদের বসবাসের জন্য একটি শেড তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও সমাজকর্মী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘গণকবরগুলো সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে এই গণকবরের ওপর বসবাসকারী শ্রমিকরা জানেনই না তাদের বসবাসস্থলের নিচে গণকবর রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রিজসংলগ্ন গণকবরের ওপর একজন আইনজীবীসহ কয়েকজন দখলদার ঘর তুলে দখল করে নিলেও সাবেক পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ তাহের ঘরগুলো উচ্ছেদ করে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই স্থানটি আবারও বিলুপ্ত হতে চলেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে এই গণকবরের ওপর জনৈক ব্যক্তি মুলা ও সবজি চাষ করছেন। এ স্থানে গণকবর থাকার কোনো চিহ্ন বা সাইনবোর্ড না থাকায় এখানে যে গণকবর আছে তা কেউ জানতে পারছেন না।
সদর উপজেলার দালাল বাজার খোয়াসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের বেলতলা নামক স্থানের গণকবরের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করায় তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
একই উপজেলার জকসিন পূর্ববাজারে রয়েছে নোয়াখালীর ঐতিহাসিক বগাদিয়ার যুদ্ধে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সামসুর কবর। গত কয়েক বছর ধরে এই কবরের উত্তর পাশে থাকা প্রাচীর জনৈক প্রবাসী শহিদ মিয়ার লোকজন প্রাচীর ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলে। সম্প্রতি তারা কবরের প্রাচীর পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে তার ওপর মাটি ফেলে আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। কবরের ওপরে থাকা দুইটি আমগাছ কেটে ফেলারও ষড়যন্ত্র করছে বলে স্থানীয়রা জানান।
লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়ী গণকবরের একটি সীমিত অংশ সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হলেও এই গণকবর এলাকার বিশাল অংশ প্রভাবশালীরা বহুতল মার্কেট তৈরি করে দখল করে নিয়েছে। জেলার বাসু বাজারের গণকবর ও নাগের হাটের গণকবর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হলেও অন্যগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হুমায়ুন কবির তোফায়েল বলেন, ‘জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও গণকবরগুলো সংরক্ষণ করার জন্য তিনি বারবার প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। তিনি আফসোস করে বলেন, যাদের রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের সমাধিগুলো আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এটা ভাবতেই বড় কষ্ট হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. শাজাহান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কবরগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশাবাদী।