• বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন

এনজিওকর্মী থেকে পেশা বদল করে হয়েছেন সকল রোগের চিকিৎসক, চেম্বারেই করেন অপারেশন!

ডেস্ক রিপোর্ট / ১৭ Time View
Update : শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

একসময় এনজিওকর্মী ছিলেন মো. আতিকুর রহমান আতিক। বর্তমানে তিনি রাজশাহী নগরীর লোকনাথ স্কুল মার্কেটে ‘অহোনা’ নামের একটি ফার্মেসি পরিচালনা করছেন। ওই ফার্মেসির এক কোনায় স্থাপন করেছেন নিজস্ব চেম্বার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কোনো সনদ না থাকা সত্ত্বেও ফার্মেসির ভেতরেই করছেন রোগী দেখা, ক্ষত সেলাই, সুন্নতে খাতনা, এমনকি অপারেশনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও। নিজেকে ‘সব রোগের বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি। তার ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর গুরুতর শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মৃত্যুর অভিযোগও উঠেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাজরাপুকুর কলোনির বাসিন্দা হালিমা বেগম ওরফে হজোবা (৬৫) তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে সংক্রমণজনিত সমস্যার জন্য গত ৭ মার্চ আতিকের ফার্মেসিতে যান। আতিক তখন নখ কেটে সেখানে পুঁজ বের করে দেন এবং কিছু ওষুধ দেন। দুদিন পর ফলোআপে গেলে তিনি আঙুলে পোকার ডিম রয়েছে বলে জানান এবং তারপিন নামক একটি ক্ষতিকর তরল পদার্থ ইনজেকশনের মাধ্যমে আঙুলের তিনটি স্থানে পুশ করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেই রাতেই হজোবার পায়ের পাতা অস্বাভাবিক ফুলে লাল হয়ে যায় এবং প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। পরদিন আবার আতিকের কাছে গেলে তিনি কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ফেরত পাঠান। কয়েকদিন পর রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হলে তিনি আবার ফার্মেসিতে যান। তখন আতিক জানান, চিন্তার কিছু নেই এবং দুটি ট্যাবলেট খাওয়ার পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পর রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

পরিবারের সদস্যরা তাকে রাজশাহীর ডলফিন ক্লিনিকে নিয়ে গেলে সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. এনামুল হক জানান, দেরি না করে দ্রুত আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে হবে, না হলে সংক্রমণ সারা পায়ে ছড়িয়ে পড়বে। পরে সেদিনই অস্ত্রোপচার করে আঙুলসহ পায়ের সামনের অংশ কেটে ফেলতে হয়।

হজোবার ছেলে মো. খোকন জানান, ‘আমার মায়ের পায়ের নখ ভেতরে ঢুকে পেকে গিয়েছিল। আতিক প্রথমে ওষুধ দিয়ে পরিষ্কার করেন। পরে বলেন, আঙুলে পোকার ডিম রয়েছে। তারপিন পুশ করে দেন। এরপর পা ফুলে যায়, ব্যথা বাড়ে। শেষে ক্লিনিকে গিয়ে জানতে পারি পা কেটে ফেলতে হবে। আমি চাই, এমন ভুল চিকিৎসায় আর কেউ যেন অঙ্গহানি না করে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, রমজানের শুরুতে আরও এক রোগী আতিকের কাছে চিকিৎসা নিতে যান। আতিক তাকে ইনজেকশন দিয়ে ফার্মেসিতে বসিয়ে রেখে পাশের দোকানে চা খেতে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মেসির সামনেই রোগীটি মারা যান। পরে মৃতদেহ দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন আতিক। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীকে মৃত ঘোষণা করেন।

আতিকের ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি এক রোগীর হাতের ক্ষতস্থানে সেলাই দিচ্ছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এটি তার প্রতিদিনের কাজের অংশ। নিজেকে এলএমএএফ (পল্লি চিকিৎসক) পরিচয় দিলেও কোনো বৈধ সনদপত্র তিনি দেখাতে পারেননি।

ফার্মেসির পাশের দোকান ‘খেলনা সাইকেল স্টোর’-এর মালিক আরিফুল ইসলাম আরিফ জানান, ‘আতিক কোনো চিকিৎসক না হয়েও সব ধরনের চিকিৎসা করেন। ইনজেকশন দেওয়া, খাতনা, কাটা-ছেঁড়া, সেলাই—সবই করেন। রমজানে একজন রোগী এখানে মারা গেছেন। আরও বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবুও তার ফার্মেসিতে সবসময় রোগীর ভিড় লেগে থাকে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আতিক একসময় একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। পরে ফার্মেসি চালু করে নিজেকে চিকিৎসক দাবি করেন। তার সাবেক এক সহকর্মী জানান, ‘সে আগে আমার সহকর্মী ছিল। ফার্মেসি দিয়ে ওষুধ বিক্রি করত। এখন যে কাটা-ছেঁড়া, অপারেশনও করছে, সেটা আমি জানতাম না।’

প্রতিবেদক পরিচয় দেওয়ার পর আতিক স্থানীয় এক রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান।

জানতে চাইলে আতিক বলেন, ‘এর আগেও এমন রোগী এসেছিল, তারপিন দিয়ে ভালো হয়েছিল। হজোবার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হয়েছে।’ এক রোগী মারা যাওয়ার ঘটনায় তিনি বলেন, ‘সে খারাপ অবস্থা নিয়ে এসেছিল, আমি হাসপাতালে যেতে বলি, পরে সেখানে সে মারা যায়।’

আতিকের কাছে প্রশ্ন করা হয়, একজন এলএমএএফ হয়ে তিনি কীভাবে সেলাই বা কাটা-ছেঁড়ার মতো চিকিৎসা করছেন। তিনি জবাবে বলেন, ‘রোগীরা অনুরোধ করে বললে তো করতে হয়। আজও একজন ডায়াবেটিক রোগী সামান্য ক্ষতের জন্য সেলাই দিতে অনুরোধ করেন। আমি রোগীর অনুমতি ছাড়া কিছু করি না।’

কোন সনদের ভিত্তিতে তিনি চিকিৎসা করছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘রোগীর চাপ অনেক। কাগজপত্র কোন কার্টুনে আছে মনে নেই, খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।’

এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসনের রাজশাহী জেলার তত্ত্বাবধায়ক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি ফার্মেসিতে একজন ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না। আইন লঙ্ঘন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোসাম্মৎ মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসা দেওয়া আইনত গুরুতর অপরাধ। এটি শহরের মধ্যে ঘটছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category