টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাওলানা সা’দ ও মাওলানা জুবায়ের সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের চলমান বিরোধ রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নিয়েছে। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) টঙ্গীতে তুরাগ ময়দানে দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত ও বহু অনুসারী আহত হয়েছেন। প্রায় ৯ বছর ধরে চলে আসা এই বিরোধের নেপথ্যে নানা কারণকে দেখছেন ওই দুই পক্ষের অনুসারীরা। তবে এর মধ্যে ইজতেমার প্রধান মুরব্বি বা আমিরের নেতৃত্ব এবং সা’দের খুতবাকেন্দ্রিক মতবিরোধ অন্যতম।
বুধবার তুরাগের ওই ভয়াবহ সংঘাতের পর থেকে তাবলিগ জামাতের মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ কান্ধলভী এবং মাওলানা জুবায়ের আহমেদের একাধিক অনুসারীর সঙ্গে নেপথ্যের বিরোধ নিয়ে কথা হয়। তারা জানান, আকিদা নিয়ে তাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে মাওলানা সা’দের বয়ান বা খুতবার কিছু অংশ নিয়ে জুবায়েরপন্থিদের আপত্তি আছে। ভিন্ন মতবাদ দেওয়ার অভিযোগ আছে সা’দের বিরুদ্ধে। তবে সা’দপন্থিরা এ বিষয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সঠিকপথ বের করার জন্য বারবার আহ্বান জানালেও জুবায়েরপন্থিরা তাতে রাজি হননি বলেও পাল্টা অভিযোগ রয়েছে।
তাবলিগ জামাতের মাওলানা সা’দপন্থি শাইখ আল মুরছালিন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোতে কোনো মতভেদ নেই, যা আছে সেটা প্রধান মুরব্বি বা আমিরের নেতৃত্ব মানা না মানা নিয়ে। আমরা আলোচনায় বসে বারবার এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু অপর পক্ষ (জুবায়েরপন্থি) সবসময় তা এড়িয়ে গেছে। বরং উগ্রতা দেখিয়েছেন তারা।’ তিনি বলেন, ‘তুরাগে যে ঘটনা ঘটে গেল এটা আমাদের ইসলামের দাওয়াতদানকারী সবার জন্যই অত্যন্ত দুঃখের। সংকট কমার চেয়ে আরও বেড়ে গেল।’
এদিকে মাওলানা জুবায়েরপন্থি দুইজন অনুসারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মাওলানা সা’দ বিতর্কিত ও ভ্রান্ত বয়ান দিয়ে বিকৃত খুতবা দেন। সেখান থেকেই মূলত তার নেতৃত্ব না মানার বিষয় ওঠে আসে। আমাদের সিনিয়র মুরব্বিরা এ বিষয়ে ইতোপূর্বে যা বলেছেন, অর্থাৎ মাওলানা সা’দকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে তার কোনো বিকল্প নেই। আমরা এর বাইরে কিছু বলতে চাই না।’
জানা যায়, তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমার নেতৃত্বের সংকট মূলত ২০১৫ সালের দিকে শুরু হয়। আগের যিনি আমির বা প্রধান মুরব্বি ছিলেন তিনি মারা গেলে ওই সময়ে ইমাম বা আমির নির্বাচন নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। তখন হাজি আব্দুল মুকিতসহ ৯-১০ জনের একটি শুরা কমিটি গঠন করা হয়। ওই শুরা কমিটি আমির হিসেবে দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা ইজহারুল হাসান, দিল্লির মাওলানা জুবায়রুল হাসান কান্ধলভী ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর নাম প্রস্তাব করেন। তখন মাওলানা সা’দ তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ছিলেন। এরই মধ্যে ইজহারুল হাসান ও জুবায়রুল হাসান কান্ধলভী মারা গেলে বিশ্ব ইজতেমায় আমির হিসেবে সামনে আসেন সা’দ কান্ধলভী। কিন্তু ওই শুরা কমিটির মধ্যে থাকা অন্তত দুইজন মাওলানা মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও মাওলানা আহমেদ লাট সাহেব মাওলানা সা’দকে বিশ্ব ইজতেমার প্রধান মুরব্বি হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। মতবিরোধ থেকে মাওলানা ইব্রাহিম ও মাওলানা আহমেদ লাট আলাদাভাবেই তাবলিগের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। সে সময়ে বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের আহেমদ ও তার অনুসারীরাও মাওলানা সা’দের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি বা বিকৃত বয়ানের অভিযোগ তুললে মতবিরোধ শুরু আরও জোরালো হয়। ফলে ২০১৬ সাল থেকে চলে আসা সেই মতবিরোধ এখনো মেটেনি। বরং গতকাল দুই পক্ষের বিরোধ গড়ালো রক্তক্ষয়ী সংঘাতে।