• বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৫ পূর্বাহ্ন

পরিবারের মধ্যমনি ছিলেন রায়হান, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় দিশেহারা পরিবার!

সামিয়ান হাসান / ৯৯ Time View
Update : শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে একদিন ইউরোপ যাবেন। সেখানে গিয়ে পরিবারের সমস্ত অভাব ঘোচাবেন। সংসারের সমস্ত চাহিদা পূরণ করে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবেন। অসুস্থ বাবাকে উন্নত চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলে তার হাসি ফুটানোর দৃড় প্রত্যয় ছিল। সেজন্য পড়াশোনা করার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে ছোট একটা ঝুপড়ি ঘরে শুরু করেন চায়ের দোকান। সেই দোকানের আয় দিয়ে পরিবারের সকল সদস্যদের বরণ পোষন করতেন রায়হান। হঠাৎ একদিন বড় ভাই একই সংসার থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার কারণে তার ঘাড়েই এসে পড়ে সংসারের সব দায়দায়িত্ব। ছাত্রবস্থায় বাস্তবতা তাকে দায়িত্ববান হতে শেখায়। সেই দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে হয়ে উঠেন পরিবারের মধ্যমনি। সেই থেকে সুন্দর পরিপাটি করে সংসার চালাচ্ছিলেন তিনি। পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুটানো রায়হানের জীবন প্রদীপ নিভে যায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত হওয়ার পর বিয়ানীবাজারে ছাত্রজনতার বিজয় উল্লাসে অংশ নিয়ে। একটি বুলেটে রায়হানকে কেড়ে নেয় পরিবারের কাছ থেকে। রক্তে রক্তাক্ত হয়ে নিথর দেহ সেদিন পড়েছিল সড়কে। রায়হানের জীবনাবাসনের সাথে সাথে একটি পরিবারের স্বপ্নের সমাধি ঘটেছিল সেদিন। ছেলে হারানোর শোক, আর্তনাদ বাবাকেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন ম্লান করে দিয়েছে। অভাবগ্রস্ত সংসার এখন ঘিরে ধরেছে বিষাদে। ছেলের অকাল মৃত্যু আজো মেনে নিতে পারছেন না বাবা-মা, ছোট ভাইয়েরা।
বিয়ানীবাজার উপজেলার নয়াগ্রামের ফারুক আহমেদ ও রাহেলা বেগম দম্পতির চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিল রায়হান। ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার সরাইল তেলিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা হলেও স্বপরিবারে বসবাস বিয়ানীবাজারে। রায়হানের বড় ভাই বোরহান পেশায় অটোরিকশা চালক। ছোট ভাই সিয়াম চায়ের দোকানে কাজ করেন এবং সর্বকনিষ্ঠ ভাই সোহরাব মাদরাসায় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।
গত ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে বিজয় উল্লাস করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রায়হান উদ্দিন। ওইদিন বিয়ানীবাজার থানা সংলগ্ন ওয়ালটন প্লাজার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
ছেলে হারা ফারুক আহমদ বলেন, একটি ফোন কল এর মাধ্যমে রায়হান গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান তিনি। মাগরিবের নামাজের পর রায়হানের বন্ধুবান্ধবসহ মিলে গুলিবিদ্ধ রায়হানের নিথর দেহ উদ্ধার করেন নিয়ে আসেন। তখন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় রায়হানের ময়না তদন্তও হয়নি। পরদিন ৬ আগষ্ট সকাল ১০টায় ব্রাহ্মনবাড়ীয়ায় গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে তাকে দাফন করি। কথা বলার ফাঁকে চোখ গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। বাবার কাঁধে ছেলের মরদেহ যে কতই না যন্ত্রণার, তা ফারুক আহমদকে না দেখলে অনুমান করা বড়ই কঠিন। কেবল ধুকরে ধুকরে কেঁদেই যাচ্ছিলেন।
নিজেকে সামলে নিলেও ছেলে হারানোর রাহেলা বেগমের কান্না থামানো তার জন্য আরো দুঃসাধ্য। ছেলে হারানোর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও রায়হানের মায়ের অশ্রু যে থেমে নেই।
কান্না থামিয়ে ফারুক আহমদ বললেন, রাযহান ছেয়েছিল দেশের বাইরে গিয়ে স্বাবলস্বি হবে। পাশাপাশি পড়ালেখাটাও চালিয়ে নিবে। কিন্তু আমার ছেলের সেই আশা রাস্তার ধুলায় মিশে দিলো একটি বুলেট। যে ছেলে পরিবারের দায়দায়িত্ব নিয়েছিল। সেই ছেলে না থাকায় আমাদেরকে দেখার কেউ রইল না। জীবন আরো বিষাদে ভরে গেলো। এখন সংসারের হাল ধরার কেউ রইল না।
রায়হানের মা রাহেলা বেগম বলেন, রায়হান মধ্যপাচ্যের দেশ কাতার যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। ১৫ আগষ্ট যাওয়ার কথা ছিল কাতারে। এর আগেই বিষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে মারা গেল সে। ছেলে হারানোর কষ্ট আমি কি করে সইবো। একজন মা ছাড়া এই কষ্ট তো কেউ বুঝবে না। বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। সবার কাছে তার ছেলের জন্য দোয়া চান রাহেলা বেগম।
রায়হানের ছোট ভাই সিয়াম বলেন, ১৮ বছর আগে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া থেকে সিলেটে পাড়ি জমান তার বাবা ফারুক আহমদ। মাথায় কাপড়ের গাট্টি ফেরি করে বিক্রি করাই ছিল তার বাবার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। এ থেকে যে আয় হতো, তা দিয়ে ভালভাবেই সংসার চলছিল তাদের। কিন্তু ১০ বছর আগে বড়লেখার দাসের বাজার রাস্তা পারাপারে সময় চলন্ত ট্রাকের আঘাতে মেরুদন্ড আঘাত পান তার বাবা ফারুক আহমেদ। এ কারণে তিনি কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে বিয়ানীবাজারে বাসার কাছে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। ছেলেদেরকে পড়ালেখা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে বড় ভাই বোরহানকে বিয়ে করালে তিনি আলাদা হয়ে যান। তাতে সংসারের চাপ আরো বাড়ে। সেই থেকে রায়হান ভাই চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। ভাই হারিয়েছি। বাবা-মা দুজনেই বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ। এখন আমার উপর সংসারের চাপ। রায়হান ভাই বেঁচে থাকতে দুজনে মিলেমিশে সব কিছু মেনেজ করে নিতাম। এখন তার ভাই রায়হান হত্যার প্রকৃত দোষীদের বিচার দাবি করেন তিনি। সিয়াম বলেন, আমার ভাইকেতো আর ফিরে পাবনা। কিন্তু রায়হান কে যারা হত্যা করেছে তাদের যেন বিচার হয়।
এদিকে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় ২৬ আগষ্ট বিয়ানীবাজার থানায় একটি মামলা (নং ৮ (৮) ২৪) দায়ের করা হয়। ওই মামলায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সিলেট জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লবসহ ৩০ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৮০ জনকে আসামি করা হয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category