• বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন

মৌলভীবাজারে বিএসএফ এর বাধায় নদীর বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ, চলতি মৌসুমে বন্যার আশংকা

ডেস্ক রিপোর্ট / ৭ Time View
Update : বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজের ৪ বছর পার হলেও বিএসএফের বাধা, জমি অধিগ্রহণ ও অর্থসংকট জটিলতায় কাজ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় এ বছরও বর্ষা মৌসুমে ফের বন্যার আশঙ্কা করছে নদীতীরবর্তী ৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ।

ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাধার কারণে উপজেলার সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নে মনু নদী প্রতিরক্ষা বাঁধের ৪টি স্থান ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের একটি স্থানে কাজ শুরু হয়নি। বাংলাদেশ অংশে কাজ না হলেও ভারতের অংশে দিব্যি কাজ চলছে বিএসএফের উপস্থিতিতে।

এ নিয়ে স্থানীয় সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এর আগে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা একাধিকবার মানববন্ধন করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। আসছে বর্ষা মৌসুমের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা উন্নয়ন সভায় মনু নদীর কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে আলোচনা হয়।

এর প্রেক্ষিতে সোমবার (২১ এপ্রিল) দিনব্যাপী মনু নদীর চলমান বিভিন্ন বাঁধের কাজ পরিদর্শন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন।

এ সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মনু নদীর ভয়াবহ বন্যার ভাঙন রোধে মৌলভীবাজার জেলার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলাকে বন্যা ও নদীভাঙন থেকে মুক্ত রাখতে ২০২০ সালের ২১ জুন ৯৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার এই বৃহৎ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ প্রকল্পে কুলাউড়া উপজেলায় মোট ২৮টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে।

যার মোট চুক্তিমূল্য ৩০৭ কোটি টাকা। ২৮টি প্যাকেজের মধ্যে স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজের ২০টি, চর অপসারণ কাজের ৪টি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনারাকৃতিকরণ কাজের ৪টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে।

প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলায় কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। সীমান্তবর্তী কুলাউড়ার শরীফপুর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম, নিশ্চিন্তপুর, তেলিবিল ও বাগজুরসহ মোট ৪টি স্থানে মোট ২ কিলো ২০০ মিটার অংশে স্থায়ী নদী তীর সংরক্ষণ কাজ রয়েছে। কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

২০২১ সালে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স বাঁধ মেরামত ও তীর সংরক্ষণের কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ তৈরির কাজ সম্পন্ন করে রাখে। কিন্তু ৪টি স্থানে ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে বিএসএফের বাঁধার কারণে কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

সরেজমিনে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া বেঁড়িবাঁধ এলাকায় দেখা যায়, বিএসএফের বাঁধায় ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১০০ ফুট ভাঙনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ভারতের মাগুরউলি, দেবীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কাঁটাতার ঘেঁষে বেড়িবাঁধে বিএসএফের উপস্থিতিতে কাজ চলছে জোরেসোরে। এ সময় দেখা যায়, বড় বড় লরিতে করে মাটি ফেলে বেড়িবাঁধ উঁচু করা হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ফয়জুল হক, মখলিছ মিয়া, আতিক মিয়া বলেন, ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। এর আগেও ২০১৮ সালের বন্যায় উপজেলার টিলাগাঁও, হাজীপুর, শরীফপুর ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নে অর্ধ-শতাধিক গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তারা জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বাড়লে প্রতিরক্ষা বাঁধ, নদী আর গ্রাম কোনটির কোনো অস্তিত্ব থাকে না। সেইসঙ্গে এ ইউনিয়নগুলোর বানভাসি লোকজন প্রতিটি মুহূর্তে বন্যা আতঙ্কে তাদের দিন কাটায়।

তারা আরো বলেন, বিএসএফের বাঁধায় বাংলাদেশ অংশে কাজ বন্ধ হলেও ভারতীয় অংশে ঠিকই কাজ চলছে। দ্রুত প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করে যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন না করা যায় তাহলে আবারো নদী ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছেন মনু পাড়ের মানুষ।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাব্বানী কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার রুবেল আহমদ বলেন, মন্দিরা এলাকায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু সময়মতো কাজের বিল না পাওয়ায় হতাশ। এদিকে প্রকল্প এলাকায় কয়েকটি ঘর পুনর্বাসন না করায় পুরো কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।

পৃথিমপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল লতিফ বলেন, এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখের নাম হলো খর স্রোতা মনু নদী। যখনই নদীতে পানি বাড়ে তখন এই নদীটি পৃথিমপাশা, টিলাগাঁও, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়ন দিয়ে ভাঙন দেখা দেয়। বন্যা হলে হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের ৫টি সীমান্তবর্তী স্থানে কাজ বন্ধ থাকলেও ভারতের অংশে বিএসএফের উপস্থিতিতে বেঁড়িবাধের কাজ চলছে। এখন যদি বাংলাদেশ অংশে কাজ না করা হয় তাহলে ভারতীয় অংশের কাজ শেষ হয়ে গেলে বিএসএফ আরো কঠোর হবে বলে আশঙ্কা করছি।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ বলেন, কুলাউড়ায় এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বিএসএফের বাঁধায় শরীফপুর ইউনিয়নে চারটি স্থানে ১৪০০ মিটার কাজ বন্ধ রয়েছে। ৪টি স্থানের কাজের অনুমতি চেয়ে ২০২৩ সালে যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ হতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন ভারতের নয়াদিল্লীতে একটি পত্র প্রদান করা হয়। সর্বশেষ মার্চ মাসে কলকাতায় দু’দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনাসভা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অনুমোদন আসেনি।

তিনি আরো বলেন, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের কাজ গত বছর শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিএসএফের বাঁধায় কাজ শুরু করা যায়নি। যথাসময়ে কাজ শেষ না করলেও এ বছরও ফের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যান্য এলাকায় নদী প্রতিরক্ষার কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। যথাসময়ে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মনু নদীর বৃহৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে জেলা উন্নয়ন সভায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শনে প্রকল্প এলাকায় যে সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার রয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিএসএফ কর্তৃক কাজে বাঁধার বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category