বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সিলেটে অর্জিত সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তিনি মৌলভীবাজার-২ আসনের এমপি ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ায় পরপরই নাদেলও দেশ ছেড়ে পালান। এখন তার অবস্থান ভারতের কলকাতায়। সেখানে থেকে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। সিলেটে পলাতক থাকা নেতাদের একত্রিত রেখে দুর্দিনে দলকে চাঙ্গা করার মিশনে ব্যস্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। ঈদ পরবর্তী সময়ে সিলেটে ফের আঘাত হয়েছে নাদেলের পৈতৃক ভিটা নগরের হাউজিং এস্টেটের ফরিদবাগ বাসায়। সেখানে তিনি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। এরমধ্যে দু’তলার ফ্ল্যাট রেখে তিনি বাসার অন্তত ১৮টি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে এখন তার দু’তলার বড় পরিসরের ওই ফ্ল্যাট। ৫ই আগস্টের দিন নাদেলের বাসায় ব্যাপক ভাঙচুর করেছিল ছাত্র-জনতা। এতে বাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ঈদ পরবর্তী সময়ে নাদেল বলয়ের নেতাকর্মীদের মিছিলের কারণে ওই ফ্ল্যাটটি পুনরায় ভাঙা হয়।
দাবি করা হচ্ছে ফ্ল্যাটে লুট করা হয়েছে। যাই ঘটুক দ্বিতীয় দফায় ভাঙচুরের ক্ষেত্র নাদেল নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। মৌলভীবাজারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ ক’বছর রাজনীতি করেছেন ঢাকায়। এখনো আছেন ময়মনসিংহ বিভাগ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নেতা হিসেবে। কিন্তু সিলেটেই নাদেলের সব। সিলেট আওয়ামী লীগে তার একটি বলয় রয়েছে। যেটি ছাত্রলীগের নুর হোসেন ব্লক বা দর্শন দেউরী গ্রুপ নামে পরিচিত। ঈদের পরপরই নগরের ধোপাদীঘিরপাড়ে নাদেলের ছবি সম্বলিত একটি ব্যানার নিয়ে কয়েক মিনিটের মিছিল করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এতেই ক্ষোভ দেখা দেয়। বিকালে ছাত্র-জনতার ব্যানারে নগরের ৭-৮ জন নেতার বাসায় ভাঙচুর করা হয়। নগরে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বেশি ভাঙচুর হয়েছে সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরীর বাসায়। এ দুটি বাসায় ঘণ্টাব্যাপী ভাঙচুর করা হয়। এরপর থেকে সিলেটে শেকড় গেড়ে বসা নাদেল পিছুটান দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা। সিলেট নগরে নাদেলের সম্পত্তি ঢাকার তুলনায় খুবই কম। বিতর্ক এড়িয়ে বিগত দিনে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনটি বাসার মালিক হয়েছেন। এ তিনটি বাসা তার নিজের নামে ছিল না। নিজের একান্ত অনুসারী ও আত্মীয়স্বজনের নামে এসব বাসা ক্রয় করেন। সিলেটে নাদেল অর্ধকোটি টাকার যে পাজেরো জিপ চালাতেন সেটিও তার নিজের নামে নয়। পরিবারের এক সদস্যের নামে ক্রয় করা। নাদেলের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন- গাড়িটি সম্প্রতি তিনি বিক্রি করতে চাইছেন। এ গাড়িটি শোরুমে রয়েছে। ৫ই আগস্টের পর সেটি নিরাপদ স্থান হিসেবে শোরুমে রাখা হয়। অর্ধকোটি টাকার মূল্যের এই গাড়ির দাম ১৯ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এ ছাড়া- নগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডসহ কয়েকটি এলাকায় থাকা তিনটি বাড়ি তিনি বিক্রির চেষ্টা করছেন। এই বাড়িগুলো যাদের নামে তারা সিলেটে রয়েছেন। সিলেটের সম্পত্তি বিক্রির কারণ কী- এ প্রশ্নের জবাবে তার এক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, সিলেটে ছাত্র জনতার নামে দ্বিতীয় দফা বাড়িঘরে হামলার পর নাদেল পিছুটান দিয়েছেন। কারণ দ্বিতীয় দফায় ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পুলিশ অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলায় জর্জরিত হননি এ রকম অনেক নেতা বাড়িঘরে ফিরেছিলেন। এ ঘটনার পর তারা ফের বাড়িঘর ছাড়া রয়েছেন। ফলে সবকিছু মিলিয়ে নাদেল সিলেটে ব্যাকফুটে রয়েছেন। এ ছাড়া ৮ মাস ধরে নাদেল ভারতে পলাতক। ওখানে সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতাদের দেখভালের দায়িত্ব অনেকটা তার ওপর। যাকে যেভাবে পারছেন সহযোগিতা করছেন। ৯ই ডিসেম্বর সিলেটের ৫ নেতা কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ডাউকিতে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় তাদের গ্রেপ্তার করার পর তাদের ছাড়িয়ে নিতে নিজেই শিলং আদালত পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করেন। তাদের মুক্ত করার প্রক্রিয়ার খরচের এক অংশ তিনি বহন করেছেন।
নেতারা জানিয়েছেন- ভারতে থাকা সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতাদের এখন অভিভাবক নাদেল। সংকটকালীন সময় অতিবাহিত করতে টাকার প্রয়োজনে তিনি সিলেটের সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় নাদেল আওয়ামী লীগের নেতা থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে তার আধিপত্য ছিল না। তবে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তিনি পরবর্তীতে ধীরে ধীরে দাপটবাজ নেতা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। ২০১৯ সালে নাদেল রাজনীতির মহা পরীক্ষায় পড়েছিলেন। ওই সময় নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়া নালেদকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যন্ত নিয়ে পৌঁছান প্রয়াত মুহিত। এরপর থেকে নাদেলকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সিলেটে সবখানে তিনি আধিপত্য বজায় রেখে চলেন। দলের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন- নাদেলের হাত ধরেই সিলেট ইন্টারন্যশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম, বাদাঘাতে নতুন কারাগার নির্মাণ, আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ কয়েকটি বড় বড় উন্নয়ন হয়। আর এসব উন্নয়ন কাজে তার লোকজন এক তরফা প্রভাব খাটিয়েছেন। তারা সাব-ঠিকাদারিসহ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। এ ছাড়া নগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাওলাদারপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় নাদেলের লোকজন নামে-বেনামে জমি দখল করেছেন। বাসা দখল করেছিলেন তারা। তবে এসব সম্পত্তি নাদেল নিজের নামে না করে নিজের কাছের আত্মীয়স্বজন ও একান্ত সহযোগীদের নামে করেন। ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছে- সিলেটে নাদেলের পৈতৃক ভিটা সবাই চিনেন। এর বাইরে নাদেলের যেসব সম্পত্তি রয়েছে সেগুলো অনেকেই চিনেন না। হাউজিং এস্টেট এলাকার এক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন- হাউজিং এস্টেটে নাদেলের পৈতৃক ভিটে ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। এই সম্পদটি ফ্ল্যাট আকারে তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। অন্য এলাকায় কেমন সম্পদ রয়েছে সেটি হাউজিং এস্টেট এলাকার মানুষ জানেন না।