গত বছরের মতো এবারও দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেপ্টেম্বরে এসে এডিস মশাবাহিত এই রোগটির বিস্তার আবারও দৃশ্যমান হচ্ছে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু না হলেও তাদের নিয়ে চলতি মাসে এ পর্যন্ত এই রোগে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১০২ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪৬৫ জন। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত রোগী ১৭ হাজার ২৮৪ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এর আগে আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। আর চলতি মাসের গত ১১ দিনেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৯ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি মানুষ; যা আগস্টে ছিল এর অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে না পারলে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার লার্ভা দমনের বিশেষ কর্মসূচি চলমান বলে জানিয়েছেন দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। আর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ জানিয়েছেন, সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে রয়েছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচি।
এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৫৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। তার মধ্যে ১৫ হাজার ৫৩ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। আর এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১ হাজার ৬৬৪ জন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৩ হাজার ৯৭৮ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১০২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩৫ জন ও উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর ডেঙ্গুপ্রবণ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অনেকে এলাকাতেই এখনো মশক নিধনে দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। প্রতিবছর মশার উপদ্রব আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ দুই সিটির বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, মশার ওষুধ ছিটাতে স্থানীয় সিটি করপোরেশন অফিসে তাগিদ দেওয়ার পরও কোনো তৎপরতা তারা দেখছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশক নিধনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, গত বছর দুই মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েও ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। আর এ বছর সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী নানা অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় সেই প্রস্তুতি থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে রাজধানীর মশা নিধনের দায়িত্বে থাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এদিকে মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রশাসকরা। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
চলতি বছরের মশা নিধন কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে কিছুদিন দেশের অস্থিতিশীলতা ও সিটিতে মেয়র না থাকার প্রভাবে মশক নিধন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি নতুন প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির জন্য কমিটি করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে এডিস মশার লার্ভা নষ্ট ও উড়ন্ত মশা নিধনে নিয়মিত লার্ভিসাইডিং (লার্ভা ধ্বংস) ও অ্যাডাল্টিসাইডিং (মশা ধ্বংস) করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক ড. মুহ. শের আলী বলেন, ‘ডিএসসিসি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ও বিশেষ কর্মসূচি পরিচালনা করে চলেছে। মশার ডেনসিটি অনেকটাই কমিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার চেষ্টা চলছে। চলমান কার্যক্রমের মাধ্যমে এবার সফলভাবে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।’
ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডেঙ্গু নিধনের পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্য দেশের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০ অঞ্চলে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম মশক নিধন কার্যক্রম চলাকালে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলের আওতাধীন ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম আরও গতিশীল করার নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা রোধে এই মুহূর্তে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এডিসের হটস্পট ম্যানেজমেন্ট, লার্ভা ম্যানেজমেন্ট, লার্ভা সোর্স ম্যানেজমেন্টকে এখন গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। লোকবল কম থাকলে প্রয়োজনে অন্য জায়গা থেকে লোক এনে এই কাজগুলো করতে হবে।
দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এখনো ভালো আছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে তিনি জানান, পরিস্থিতি যেমনই থাক, সরকার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে রয়েছে। ঢাকার বেশির ভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবারও একই সময়ে (সেপ্টেম্বরে) ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, সরকারি হিসাবে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই বছর। অথচ তার আগের বছর, ২০২২ সালে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮৬৮ জন। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ে মৃত্যুর হার। এ বছর মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কম, তবে কিছু দিন ধরে হাসপাতালে বাড়তে শুরু করেছে রোগীর সংখ্যা। তাই ডেঙ্গু নিয়ে এখনই বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।