• মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

হাসপাতালে রোগীর খাবার স্বজনদের কাছে বিক্রি করছে সিন্ডিকেট চক্র

ডেস্ক রিপোর্ট / ৩০ Time View
Update : শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড। এক তরুণকে তখন খাবারের ট্রলি নিয়ে সেখানে ঢুকতে দেখা যায়। ওয়ার্ডে থাকা নারী-পুরুষরা খালি বাটি নিয়ে তাকে ঘিরে ধরেন। অনেকের হাতে ৫০, ১০০ টাকার নোট ছিল। তারা মূলত হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের স্বজন। ট্রলি নিয়ে খাবার বিলি করতে আসা তরুণের নাম হুমায়ুন। তিনি তখন বলে ওঠেন, ‘সবাই টাকা হাতে রাখেন’। অবশ্য ভিড়ের কাছে গেলে হাতে টাকা রাখতে বলার কারণ জানা যায়।
সরকারি খাবার রোগীদের কাছে হুমায়ুনের বিলি করার দায়িত্ব থাকলেও তিনি রোগীর স্বজনদের কাছে তা বিক্রি করছিলেন। শুধু ওই দিনই নন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। রোগী বেশে হুমায়ুনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কয়েকজনের খাবার নিতে হলে কী করতে হবে? জবাবে হুমায়ুন বললেন, ‘এত লজ্জা কীসের। আমাকেই বলবেন। একজনের জন্য ৫০ টাকা, দুইজনের ১০০।’ টাকা আগে বুঝে নিয়েই ঝটপট ভাতের সঙ্গে ডাল ও মাংস মিশিয়ে দিলেন। অনেকটা ডালে-চালে খিচুড়ি কিংবা বিরিয়ানির মতো অবস্থা।

রোগীরা জানিয়েছেন, হুমায়ুন নিয়মিত এটা করে থাকেন। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত হুমায়ুনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এতে রোগীদের অভিযোগের সত্যতা মেলে। ওই ওয়ার্ডে প্রতি বেলায় তাকে কমপক্ষে ১ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়।

এদিকে রোগীদের খাবার বিক্রির কারণ জানতে চাইলে প্রতিবেদকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হুমায়ুন। তার বিরুদ্ধে রোগীদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার এবং হাসপাতালের খাবার বাইরে সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। গত রবিবার রাতে এক নারী তার কাছে খাবার চাইতে গেলে প্রতিবেদকের সামনেই তিনি ওই নারীকে কটু কথা বলেন, যা শুনে ওই নারী ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা স্বজনের জন্য খাবার না নিয়েই চলে যান।

অভিযোগ আছে, শুধু হুমায়ুন নন, হাসপাতালের খাদ্য বিভাগে কর্মরত প্রায় সবাই এ কাজে জড়িত। কেউ কম, কেউ বেশি। শীর্ষস্থানে আছেন আইয়ুব আলী, মনির, কামাল উদ্দিন, জয়নাল, খায়রুল আমিন, রুহুল আমিনসহ কয়েকজন। ৩৯ জন কুক বা মশালচি হাসপাতালের ৪৬টি ওয়ার্ডে রোগীদের খাবার বিলি করেন। তবে সরকারিভাবে ২০ জন কুক বা মশালচির নাম পাওয়া গেলেও আউটসোর্স ও স্পেশাল কুক বা মশালচিদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।

হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতিদিন একটি ওয়ার্ডে দিনে ও রাতে গড়ে ২ হাজার টাকার খাবার অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়। এতে ৪৬টি ওয়ার্ডে খাবার বিক্রি হয় প্রায় ১ লাখ টাকার মতো। এ ছাড়া রোগীদের সকালের নাস্তায় থাকা দুধ, ডিমও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
সোহাগ হোসেন নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘হুমায়ুন টাকা ছাড়া একজনের বেশি কাউকে খাবার দেয় না। অথচ ওয়ার্ডের সব রোগী সরকারি খাবার নেন না।’

শুধু রান্না করা খাবার বিক্রি নয়, চমেক হাসপাতালের খাদ্য বিভাগের দায়িত্বে থাকা ইছহাকের বিরুদ্ধে রয়েছে রান্নার উপকরণ সরিয়ে ফেলার অভিযোগ। হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, সন্ধ্যায় রান্নার উপকরণ এলে তখনই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে খাবার বাইরের দোকানে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ড থেকে আসা খাবার বিক্রির টাকাও ইছহাকের নেতৃত্বে ভাগ করা হয়। চক্রটি প্রতিদিন এভাবে অবৈধভাবে লাখ টাকা আয় করে।

হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘খাবার চুরির এই চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তারাও জড়িত আছেন। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় ইছহাকের লোকজন চুরির বাজার পৌঁছে দেয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের খাদ্য বিভাগে চারজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অর্থাৎ কিচেন সুপারভাইজার, স্টুয়ার্ড, ডায়টেশিয়ান, অফিস সহকারী থাকার কথা থাকলেও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইছহাক একাই চারটি পদ দখল করে আছেন। পদের দিক থেকে কুক বা মশালচি হয়েও দুই বছর ধরে খাদ্য বিভাগের সবকিছু তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার হাতেই হচ্ছে হাসপাতালের কোটি টাকার হিসেব-নিকেশ।

জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ইছহাক বলেন, ‘রোগীদের সঙ্গে খাবার বিতরণের দায়িত্বে থাকা হুমায়ুন এ ধরনের ব্যবহার করতে পারেন না। আমি বিষয়টি পরিচালককে জানাব।’ খাবার বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকজন কুক বা মশালচি রোগীদের খাবার বিক্রি করে দেন।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘যারা রোগীদের খাবার বিক্রি করে দিচ্ছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেব।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category